প্রায় সব ঔপন্যাসিক এবং কবিই নিজের লেখা উপন্যাস বা কবিতা নিয়ে আবেগে আপ্লুত থাকেন। মুখে বিনয়ের ভাব করলেও, মনে মনে ঠিকই ভাবেন যে, একটা কিছু কঠিন ফাটাফা্টি, একটা কিছু কালজয়ী জিনিস করে ফেলেছেন তিনি। এক কবি ভদ্রলোকও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি কিছু কবিতা লিখেছিলেন প্রথম যৌবনের চাপল্যে। সেটিকেই তিনি বই আকারে প্রকাশ করেছিলেন। কারণ হিসাবে অবশ্য বন্ধুদের অনুরোধকে দেখিয়েছিলেন। নিজের সম্পর্কে এই কবির খুব উচ্চ ধারণা ছিলো। তিনি ভেবেছিলেন যে, নতুন ধরনের কবিতা লিখে বাংলা কাব্য রচনার রীতিকেই পাল্টে দেবেন। বইটার ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, ‘সুকাব্যালোচক মাত্রেরই অত্র কবিতা দ্বয় পাঠে প্রতীতি জন্মিবেক যে, ইহা বঙ্গীয় কাব্য রচনা রীতি পরিবর্ত্তনের এক পরীক্ষা বলিলে বলা যায়।‘
তো এই রীতি পরিবর্তনের কবিতার বই বের হলো। নাম ‘ললিতা তথা মানস’। এতে আনন্দের বদলে হতাশাই বাড়লো কবির। পাঠক, সমালোচক কেউই এই কবিতার বইয়ের দিকে ফিরেও তাকালেন না। কবির যে সমস্ত বন্ধুরা তাঁকে গাছে ওঠার জন্য মই এনে দিয়েছিলো গভীর আগ্রহের সাথে, তারাও মই বগলদাবা করে চম্পট দিলো। বইটার সর্বসাকুল্যে বিক্রি হলো মাত্র ছয় কপি। বাংলা কাব্য রচনার রীতি পরিবর্তনের পরীক্ষা পরাজয় মেনে নিলো বিনা প্রতিবাদে। বহুকাল পরে এই কবি স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, ওই কাব্যগ্রন্থটির কোনো গুণই ছিলো না।
এই রকম ব্যর্থতা সাহিত্য জগতে বিরল নয়, বরং সুলভই বলা চলে। সাহিত্যের আকাশে তারা হতে গিয়ে বহু কবি যশোপ্রার্থীই হারিয়ে যান অন্তরীক্ষের অনন্ত আঁধারে। সেই রকম অসংখ্য কবি যশোপ্রার্থীর মতো তিনিও হারিয়েই যাচ্ছিলেন প্রায়। কবিতা রচনায় হারিয়েও গিয়েছিলেন। একটা মাত্র কবিতা আকস্মিকভাবে অমরত্ব লাভ করেছিলো শুধু এই কবির। কবিতায় না পারলেও, তিনি ফিরে এলেন সাহিত্যের অন্য অঙ্গনে প্রবল দাপটে । বাংলা সাহিত্যের নমস্য ব্যক্তি হলেন উপন্যাস রচনায়। শুধু উপন্যাসেই নয়, আরো অনেক শাখাতেও নিজস্ব শক্তিমত্তা দেখালেন তিনি। এই ভদ্রলোকের নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘আমার গদ্য সাহিত্য পাঠ' বইতে লিখেছেনঃ
“প্রথম কাব্যগ্রন্থের জন্য কোনোরকম সমাদর না পেয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বেশ কয়েক বছর আর কলম ধরেননি। তারপর ইংরেজি উপন্যাস লিখেও সুবিধে করতে পারলেন না, তাতেও নিরুদ্যম না হয়ে তিনি পরের বছরই বাংলায় লিখলেন আর একটি উপন্যাস। মাতৃভাষাই যে সাহিত্য রচনার প্রকৃষ্ট বাহন, সে উপলব্ধি তাঁর হয়েছিল খুব সম্ভবত তাঁর বিখ্যাত পূর্বসূরী মাইকেল মধুসূদন দত্তের দৃষ্টান্ত থেকে। প্রথমে ইংরেজিতে কাব্য লিখে মাইকেল মধুসূদনও অপাঠ্য রচনার বোঝা বাড়িয়েছিলেন, বাংলা লিখতে শুরু করে মাইকেল রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। কিন্তু মাইকেলের চেয়ে বঙ্কিমের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছিল অনেক কঠিন। মাইকেল ইংরেজি কবিতার আঙ্গিক ধার করলেও তাঁর পিছনে ছিল বিশাল সংস্কৃত কাব্যের পটভূমিকা, বাংলাতেও কয়েক শতাব্দী ধরে উৎকৃষ্ট কাব্য সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বঙ্কিমের কাছে কোনো ভারতীয় গদ্যের আদর্শ ছিল না, বাংলা গদ্যও তখন নাবালক শিশুর মতন সদ্য দুর্বল পায়ে হাঁটতে শুরু করেছে, সেই শিশুকে দিয়ে কোনো গভীর কথা বলানো যায় না।“
বঙ্কিম যে উপন্যাসটি লিখলেন, তার নাম দুর্গেশনন্দিনী। এই উপন্যাস লেখার পরে বঙ্কিম তাঁর দুই ভাইকে পড়তে দিয়েছিলেন। তাঁদের দুজনেই, যার মধে একজন পরবর্তীতে বিখ্যাত লেখক হয়েছিলেন, মন্তব্য করেছিলেন যে, বইটি ছাপানোর যোগ্য নয়। এই অবস্থায় হতাশ বঙ্কিম বাড়িতে অনেক পণ্ডিত লোক ডেকে এনে দুই দিন ধরে এই বই পাঠ করে শোনান। এঁরা অবশ্য ভাইদের মতো অমন নিষ্ঠুর ছিলেন না। উপন্যাস পাঠ শুনে মুগ্ধ হন তাঁরা এবং এটি ছাপাবার যোগ্য বলে রায় দেন। এঁদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে বঙ্কিম উপন্যাসটা কোনো পত্রিকায় না দিয়ে সরাসরি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। দুর্গেশনন্দিনী বই হিসাবে বের হয়ে আসে। দাম মাত্র এক টাকা।
এটা প্রকাশের সাথে সাথে পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। বঙ্কিম এর পরেও আরো চৌদ্দটি উপন্যাস লিখেছেন, তার মধ্যে কোনো কোনোটা গুণে মানে এর চেয়েও ভালো। কিন্তু, এই উপন্যাসই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিলো। তাঁর জীবদ্দশাতেই এই বই বিক্রি হয়েছে প্রায় সাড়ে বারো হাজার কপি। ওই শতাব্দীতে আর কোনো বই এতো বিপুল পরিমাণে বিক্রি হয় নি।
আমরা হচ্ছি তিন কপি বই বিক্রির লেখক। এক কপি নিজে কিনি নিজের লেখার প্রতি প্রবল ভালবাসা এবং আপ্লুতা থেকে। এক কপি বউ কেনে, বইয়ের ভিতরে কী নিষিদ্ধ জিনিস আছে তা উদ্ধার করার জন্য। আর শেষ কপিটা গোপন প্রেমিকা কেনে অসহায় প্রেমিকের প্রতি মমত্ব দেখানোর জন্য। বঙ্কিমের এই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা, তিন কপি বই বিক্রির লেখকেরা গভীরভাবে অনুপ্রেরণা পেতে পারি। আজকে হয়তো দুর্বল রচনা কেউ পাঠ করছে না, কেউ হয়তো কিনছে না বই পড়ার অযোগ্য বলে। কিন্তু বঙ্কিমের ওই ছয় কপি বই বিক্রির কথা মাথায় রাখলে, কোনো হতাশাই আর চেপে বসার সুযোগ পাবে না।
হারেরেরেরে করে রণক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়াতে বাধা নেই কোনো।
No comments:
Post a Comment