Tuesday, November 10, 2015

বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়

১৯৮৭ সালে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছিলো এই বাংলাদেশে। এরকম কিছু এর আগে বাংলাদেশ দেখে নি।

এখন যে রকম কোনো আন্দোলন হলে, কিংবা প্রতিবাদ, প্রতিরোধ হলে লোকে কপালে, কপোলে কিংবা শরীরে নানা জায়গায় শ্লোগান অথবা আলপনা এঁকে নিয়ে আসে, এরকমটা আগে ছিলো না। আগে আন্দোলন সংগ্রামে ব্যানার থাকতো, ফেস্টুন থাকতো, দেয়ালে চিকা মারা হতো, রাজপথেও হয়তো বা আলপনা আঁকা হতো, কিন্তু শরীরে কোনো কিছু লিখে প্রতিবাদ জানানো হতো না। এ বিষয়টা তখনও আবিষ্কৃত হয় নি।

বিরাশি সালে একদিন রাতের আঁধারে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেই সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এরশাদ। তারপর এই লোক হেন কোনো অপকর্ম নেই যা করে নি বাংলাদেশে। গণতন্ত্র হয়ে পড়ে রুদ্ধ। মানুষ হারায় তাদের মৌলিক অধিকার স্বাধীনতা। স্বৈরাচার  এবং তার সাঙাতরা শুরু করে দেশকে পিছনে নিয়ে যাবার সকল কর্মকাণ্ড। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ। শুরু হয় আন্দোলন, সংগ্রাম আর আত্মাহুতি দেবার পালা।

সাতাশি সালের এই দিনে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে খালি গায়ে নেমে আসে এক পাগলা তরুণ। উদোম শরীরের বুকে এবং পিঠে লেখা ব্রহ্মাস্ত্র। স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, পল্টন, জিপিওতে বুকে পিঠে বাঁধা এই ভয়ংকর মারণাস্ত্র নিয়ে দাপিয়ে বেড়াতে থাকে সে ক্ষ্যাপার মতোন। শেখ হাসিনা পর্যন্ত ভয় পেয়ে যান এই তরুণের পাগলামিতে। কাছে ডেকে নিয়ে বলেন, "তোমার গায়ের লেখাগুলো ঢেকে ফেলো। এগুলোর জন্যই পুলিশ তোমাকে গুলি করবে।" দেবদূতের মতো অমলিন হাসি দিয়ে নূর হোসেন বলে, "আপা আপনি আমাকে দোয়া করুন, আমি গণতন্ত্র রক্ষায় আমার জীবন দিতে প্রস্তুত।" 

শেখ হাসিনার আশংকা মিথ্যা ছিলো না। এরকম জ্বলন্ত প্রতিবাদকে হজম করার শক্তি এরশাদ আর তার পেটোয়া বাহিনীর ছিলো না। জিপিও-র সামনে স্বৈরাচারের গদিরক্ষক পুলিশ গুলি চালায় নূর হোসেনের বুক লক্ষ্য করে। নূর হোসেনের বুক তো নয়, যেনো বাংলাদেশের হৃদয় ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যায় সেই ঘাতক বুলেট। 

গণতন্ত্র রক্ষার শপথ নিয়ে রাজপথে নামা আগুন চোখের অস্থির ক্ষ্যাপা ছেলেটা, স্বৈরাচারকে চ্যালেঞ্জ জানানো এলোমেলো চুলের দুঃসাহসী তরুণটা, কাটা কলা গাছের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় রাজপথে। 

যুগে যুগে নূর হোসেনরা এভাবেই গুলি খায়। গুলি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। পড়ে গিয়ে আমাদের এগিয়ে যাবার সুযোগ করে দেয়।

স্বার্থপর এই পৃথিবীতে পরার্থপরতার সুগন্ধময় সুবাস ছড়ায় বুলেটের আঘাতে ছিন্নভিন্ন নূর হোসেনরা।



বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়

শামসুর রাহমান

সারারাত নূর হোসেনের চোখে এক ফোঁটা ঘুমও 
শিশিরের মতো জমেনি, বরং তার শিরায় শিরায় 
জ্বলেছে আতশবাজি সারারাত, কী এক
ভীষণ বিস্ফোরণ সারারাত জাগিয়ে রেখেছে 
ওকে, ওর বুকে ঘন ঘন হরিণের লাফ, 
কখনো অত্যন্ত ক্ষীপ্র জাগুয়ার তাকে 
প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে জ্বলজ্বলে 
চোখে খর তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে, 
এতটুকু ঘুমাতে দেয়নি। 

কাল রাত ঢাকা ছিল প্রেতের নগরী, 
সবাই ফিরেছে ঘরে সাত তাড়াতাড়ি। চতুর্দিকে 
নিস্তব্ধতা ওঁৎ পেতে থাকে, 
ছায়ার ভেতরে ছায়া, আতঙ্ক একটি 
কৃষ্ণাঙ্গ চাদরে মুড়ে দিয়েছে শহরটিকে আপাদমস্তক। 
মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক নৈঃশব্দ্যকে 
আরো বেশি তীব্র করে তোলে 
প্রহরে প্রহরে, নূর হোসেনের চোখে 
খোলা পথ ওর 
মোহন নগ্নতা দিয়ে আমন্ত্রণ জানায় দুর্বার। অন্ধকার 
ঘরে চোখ দুটি অগ্নিঘেরা 
জানালা, কব্জিতে তার দপদপ করে ভবিষ্যৎ। 

এমন সকাল তার জীবনে আসেনি কোনোদিন, 
মনে হয় ওর; জানালার কাছে পাখি 
এ-রকম সুর 
দেয়নি ঝরিয়ে এর আগে, ডালিমের 
গাছে পাতাগুলি আগে এমন সতেজ 
কখনো হয়নি মনে। জীবনানন্দের 
কবিতার মায়াবী আঙুল 
তার মনে বিলি কেটে দেয়। অপরূপ সূর্যোদয়, 
কেমন আলাদা, 
সবার অলক্ষে নূর হোসেনের প্রশস্ত ললাটে 
আঁকা হয়ে যায়, যেন সে নির্ভীক যোদ্ধা, যাচ্ছে রণাঙ্গনে। 

উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠে 
রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য শ্লোগান, 
বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ 
শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা 
নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয় 
ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ 
বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার 
বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।

No comments:

Post a Comment