Thursday, November 26, 2015

প্রীতি

২০০৫ সাল।

রাজশাহী শিশু একাডেমীতে মন্ত্রী আসবেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী। প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার দেওয়া হবে। সেটারই প্রধান অতিথি তিনি। মন্ত্রীকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানানো হবে। মঞ্চের পাশেই সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর এক বাচ্চা মেয়ে। সবেমাত্র ক্লাস থ্রিতে পড়ে। খুবই সপ্রতিভ, দুর্দান্ত সাহসী এবং দারুণ চটপটে সে। যে কোনো মন্ত্রী, সাংসদ বা বিদেশী অতিথি এলে, ফুলের তোড়া উপহার দেবার জন্য সবসময়ই ডাক পড়ে তার। এই ভূমিকা আগে অসংখ্যবার করেছে বলে তেমন কোনো বিকার নেই তার মধ্যে।
হঠাৎ করে লোকজনের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। মন্ত্রী এসে গেছেন। বাচ্চা মেয়েটাও সামান্য নড়েচড়ে প্রস্তুত হয়। তার কাজ শুরু হবে এখনই যে।

মাইকে ভেসে আসে উপস্থাপকের কণ্ঠ। সম্মানিত সুধী, আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী মান্যবর আলী আহসান মুজাহিদ। তাঁকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগতম জানাবে ছোট্ট মণি প্রীতি।

ঘোষণা কানে যেতেই বাচ্চা মেয়েটা স্থির হয়ে যায়। পাশে দাঁড়ানো শিশু একাডেমীর পরিচালক সুখেন মুখার্জী আস্তে করে তাকে বলেন, 'যাও।'

যেনো কোনো কথা শোনে নি এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সে। সুখেন মুখার্জী এবার তাড়া দেন, 'কই যাচ্ছো না কেনো?'

মন্ত্রী এসেছেন। এতো বড় একটা অনুষ্ঠান। গভীর উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন তিনি।

'এই রাজাকারটাকে ফুল দেবো না আমি।' কঠোর স্বরে বলে প্রীতি।

বাচ্চা মেয়েটার কথা শুনে চোয়াল হা হয়ে যায় সুখেন মুখার্জীর। প্রীতির কথাটা ঠিকমতো শুনেছেন কিনা, সেটা নিয়েই নিজের মধ্যে সন্দেহ জাগে তাঁর। প্রবল বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেন, 'কী বললে?'

'এই রাজাকারটাকে ফুল দেবো না আমি।' টেনে টেনে কঠিন গলায় বলে প্রীতি।

পড়তে শেখার পর থেকেই বইয়ের পোকা সে। রাজাকার কী, সেটা খুব ভালো ভাবেই জানে। মুজাহিদ কী ছিলো একাত্তরে, সেটাও খুব ভালো করে জানা আছে তার।

প্রীতিকে বোঝানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালান সুখেন মুখার্জী। কোনো কাজ হয় না তাতে। একরোখা ভঙ্গিতে ঘাড় গোঁজ করে অনড় দাঁড়িয়ে থাকে সে।

প্রীতিকে পটাতে ব্যর্থ হয়ে সুখেন মুখার্জী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যান অন্য কোনো বাচ্চার খোঁজে। এই একগুঁয়ে এবং অমিত তেজি মেয়েটা যে মন্ত্রীকে ফুল দেবে না, সেটা তিনি তার ভাব দেখেই বুঝে গিয়েছেন। তিনি নিজেও এই রাজাকারটাকে দুই চোখে দেখতে পারেন না। ফুল দিয়ে একে স্বাগত জানাতে না হলে, নিজেই সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। কিন্তু, কিছু করার নেই। চাকরি তো বাঁচাতে হবে। বউ, বাচ্চা আছে তাঁর। চাকরিটা গেলে যে, না খেয়ে মরতে হবে।

সুখেন মুখার্জী চোখের আড়াল হতেই, খুঁজে পাওয়া যাবে না, এমন এক জায়গায় ফুলের তোড়াটাকে লুকিয়ে ফেলে প্রীতি তড়িৎ গতিতে।


ফুলের মালা নয়, গলায় ফাঁসির দড়ি প্রাপ্য এই সব রাজাকারদের।

শেখের বেটি

আজকে বাংলাদেশে রাজাকার-আলবদরদের বিচার হচ্ছে। সবাই খুশি আমরা। কুখ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লা, কামরুজ্জামান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসি হয়ে গেছে। গোলাম আযম, দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর জেলদণ্ড হয়েছে। মতিউর রহমান নিজামীর রায়ও খুব শীঘ্রই হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

স্বাধীনতার এতো বছর পরে এসে এই সব রাজাকারদের বিচার করাটা একটু কঠিন ব্যাপারই। সেটা আরো দুঃসাধ্য হয়েছে অন্য একটি কারণের জন্যও। স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথাতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলো একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা। তারপর থেকে আমাদের সমাজে পুষ্ট হয়েছে তারা। আর্থিক এবং রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করেছে প্রভুত। সমাজেও ভিত গড়ে তুলেছে দারুণ মজবুতভাবে। তাদের দাপট, অহংকার এবং দম্ভে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের সমাজে টিকে থাকাটাই মুশকিল হয়ে পড়েছিলো এক সময়।

এই বাংলার মাটিতে তাদের কৃতকর্মের জন্য বিচার করা যাবে, সেই আশা ছেড়ে দিয়েছিলো প্রায় সকলেই। প্রায় সকলেই, কিন্ত একজন না। সেই একজনের কথাই বলছি।

ইনি একদিন খুব ভোরে হারিয়েছেন তার পরিবারের সদস্যদের। নির্বাসিত জীবন যাপন করেছেন দীর্ঘকাল। তারপর ফিরে এসেছেন দেশে। আন্দোলন, সংগ্রাম করেছেন গণতন্ত্রের জন্য। তাঁর জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে তারেক আর বাবরের গুণ্ডাবাহিনী। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তিনি। হারিয়েছেন এক কানের শ্রবণ ক্ষমতা চিরতরে। ছদ্ম সেনা শাসকেরা তাঁকে দেশে আসতে দিতে চায় নি কেয়ারটেকার সরকারের সময়। খালেদা জিয়াকেও দেশ থেকে বের করে দীর্ঘস্থায়ী সেনা শাসন কায়েমের পরিকল্পনা ছিলো তাদের। তিনি জানতেন দেশে ফিরলে গ্রেফতার হবেন, তারপরেও ফিরে এসেছিলেন অসীম সাহসিকতা নিয়ে। তিনি আসাতে খালেদা জিয়াও শক্তি পান, নির্বাসনে যাবেন না বলে পণ করেন তিনিও। ছদ্ম সেনা শাসকেরা দুজনকে জেলের মধ্যে পুরে দেয়। দুজনের মাটি কামড়ে দেশে পড়ে থাকার কারণে বাংলাদেশ বেঁচে যায় আরেক সেনা শাসনের হাত থেকে।

তাঁর বাচালতার কারণে তিনি প্রায়শই সমালোচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি তাঁকে ছাড় দেয় না এক বিন্দুও। পারলে দুনিয়া থেকেই বিদায় করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিরও কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হন তিনি প্রায়শই। নিঃসঙ্গ একজন মানুষ তিনি। তাঁর যতোখানি প্রাপ্য ছিলো প্রশংসার, সেটা পান নি তিনি। বরং তাঁর কিছু কাজের জন্য নিন্দাটাই বেশি জুটেছে কপালে তাঁর।

তারপরেও এইটুকু বলতে আজ দ্বিধা নেই যে, তিনি না থাকলে এই সব রাজাকারদের বিচার করার ক্ষমতা বাংলাদেশে আর কারো ছিলো না। এটা করতে গিয়ে তিনি নিজের জীবনের উপরেও ঝুঁকি নিয়েছেন। চিরদিন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন না। একবার ক্ষমতা থেকে সরে গেলেই এই সব শকুন, কুকুরেরা ছিড়ে ফুড়ে খাবে তাঁকে প্রবল প্রতিহিংসায়।

অনেকেই অনেক নামে ডাকেন তাঁকে। কেউ ডাকে আপা, কেউ ডাকে বুবু, কেউ ডাকে জননেত্রী বলে। সব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি আসলে শেখের বেটি। শার্দুলের বাচ্চা যে শার্দুলই হয়, সেটা প্রমাণ করেছেন এই শেখের বেটি।

সশ্রদ্ধ সালাম আপনাকে শেখের বেটি।




Tuesday, November 24, 2015

আধুনিক চিন্তাধারায় ডারউইনের প্রভাব

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পরিবেশের সাথে বিভিন্ন প্রজাতির অভিযোজনের ধারণাকে পূর্ণাঙ্গ বিবর্তন তত্ত্ব হিসাবে রূপ দেনডারউইন। সেই তত্ত্বে প্রাকৃতিক নির্বাচনকে গুরুত্ব দেওয়া হয় প্রাকৃতিক নির্বাচনে অধিকতর সুবিধাজনক গুণগুলো বংশাণুক্রমে ছড়িয়ে যেতে থাকে পরবর্তী বংশধরসমূহের মধ্যে। ডারউইনের তত্ত্বকে জন্মের পরে শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক নীরিক্ষার মধ্য দিয়েই যেতে হয়নি, ধর্মীয় সমালোচনাকেও সইতে হয়েছে তীব্রভাবে।  তবে সেই তত্ত্ব ছিল দীর্ঘ পথের সুত্রপাত মাত্র। বিবর্তনবাদবাদ তত্ত্বের ফলশ্রুতিতে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য গবেষণা প্রশ্নের যা আজকের যুগের বিজ্ঞানীদেরকেও অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

বিবর্তনের ধারণা কিন্তু অনেক সুপ্রাচীন। এমনকি সক্রেটিসের আগেও কীভাবে যোগ্যতম টিকে থাকে সে বিষয়ে চিন্তা করা হয়েছে। অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দী জীবন কীভাবে উদ্ভব হয়েছে সে সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

ডারউইনের বিবর্তনবাদই প্রথম ঊনবিংশ শতাব্দী এবং তার পরেও বৈজ্ঞানিক শক্তপক্ত পরীক্ষাতেও টিকে গেছে। আজকের যুগে বিজ্ঞানীরা উন্নতমানের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, ক্যামেরা, কম্পিউটার, ডিএনএ স্যাম্পলিং টুল নিয়ে দিনকে দিন ডারউইনের তত্ত্বকেই  এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ডারউইনের তত্ত্বের ভৌত বিজ্ঞানসমূহের সাথে গাঢ় এবং কার্যকর সম্পৃক্ততা কারণেই এই বছর তার জন্ম দ্বিশতবার্শিকী এবং তার মাস্টারপিস কর্ম অরিজিন অফ দ্য স্পিসিসের দেড়শত বার্ষিকী পালন করা হচ্ছে বিশাল ঘটা করে

ডারউইনের তত্ত্ব আধুনিক বিজ্ঞানের একটি মৌল ভিত্তি এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্স, আপেক্ষিকতা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তির সাথে সগর্বেই দাঁড়িয়ে আছে। কোপার্নিকাস যেমন পৃথিবীকে বিশ্বজগতের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি ডারউইনের বিশ্বজগতও প্রাকৃতিক জগতের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিয়েছে মানুষকে। মানুষ আর সৃষ্টির সেরা জীব নয় এখন, নয় কোন সৃষ্টিকর্তার বাছাই করা পেয়ারের বান্দা। বরং লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অন্য আরো হাজারো প্রজাতির মত জন্ম নিয়েছে মানুষ নামের প্রজাতিটি।

প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের ধারণা বোঝা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। প্রয়োজন শুধু কিছু বিতর্কিত প্রস্তাবনাগুলোকে সংযুক্ত করা। একই প্রজাতির মধ্যেও প্রাণীসত্তা পরস্পর থেকে ভিন্ন। এবং সময়ে সময়ে নতুন ধরনের প্রাণীসত্তা উদ্ভব হয়। কিছু ভিন্নতা পিতামাতা থেকে সন্তানের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। টিকে থাকার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে প্রাণীসত্তার বিকাশ হয় কোন নির্দিষ্ট স্থানে। এর ফলে ডারউইনের ভাষায় তৈরি হয় টিকে থাকা ভয়ংকর সংগ্রাম। এই সংগ্রামে দুর্বলটি বিনাশ হয়ে যায়। সক্ষমটি টিকে থাকে। টিকে থাকাগুলো তাদের বৈশিষ্ট্যগুলোকে ছড়িয়ে দেয় তাদের সন্তানসন্ততিদের মধ্যে। দীর্ঘ সময় পরে, এই বৈশিষ্ট্যগুলোই একসময় নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটায়।

এই সহজ সরল ধারণাকে ডারউইন প্রথম খেয়াল করেননি বা ধারণাগুলোকে একত্রিত করেননি। খ্রীষ্টপূর্ব ৪৯০ সালে গ্রীক দার্শনিক এমপেডোকলস (Empedocles) বলেছিলেন যে, কেন প্রাণীরা তাদের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ায় তা প্রাকৃতিক নির্বাচন হয়তো ব্যাখ্যা করতে পারে। টিকে থাকার সংগ্রাম তত্ত্ব পাওয়া যায় ৭৭৬ সালে বসরায় জন্ম নেওয়া মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক এবং দার্শনিক আল-জাহিজের লেখা থেকে। এই ধারণা আবার ভেসে উঠে সপ্তদশ শতাব্দীতে দার্শনিক টমাস হবস এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে ডারউইনের দাদা চার্লস ডারউইনের মাধ্যমে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বিবর্তনের ধারণা ডালপালা মেলতে শুরু করে। মোটামুটি সবাই এই ধারণায় বিশ্বাস করা শুরু করে যে প্রজাতি পরিবর্তনশীল। উদ্যানতত্ত্ববিদেরা তাদের সংকর প্রজাতির মাধ্যমে তা এর মধ্যেই দেখিছিলেন। কিন্তু যে জিনিষটা কেউ জানতো না তা হচ্ছে কিভাবে এই পরিবর্তনটা ঘটে। আর এখানেই ডারউইনের সমস্ত কৃতিত্ব।

ডারউইন তার তত্তওগুলোকে রূপ দেওয়া শুরু করেন ঊনবিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের শেষের দিকে। কিন্তু সেগুলোকে প্রকাশ করতে তিনি বিশ বছর অপেক্ষা করেন। তাও হয়তো করতেন না, যদি না রাসেল ওয়ালেস নামে তার একজন প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকতো। ওয়ালেসকে টেক্কা দেবার জন্যেই ওই সময় তড়িঘড়ি করে তিনি তার তত্ত্ব প্রকাশ করেন।

ডারউইনের তত্ত্বের সূচনা ছিল একেবারে কচ্ছপ গতিতে। লাইয়েল পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ধারণাকে জীবজগতে প্রয়োগ করেছিলেন তিনি। এক প্রজাতি থেকেই আরেক প্রজাতির উদ্ভব। জীববিজ্ঞানের রূপান্তরকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন সেই সময়কার অনেক বিবর্তনবাদী চিন্তাবিদরাই। কিন্তু তখন এই রূপান্তরকে ধারণা করা হতো উর্ধমুখী রূপান্তর হিসাবে। উর্ধ্বমুখী রূপান্তর হচ্ছে এরকম যে, প্রত্যেকটা প্রজাতির উদ্ভিদ বা প্রাণীই উপত্তি হয়েছে প্রাণহীন জড় পদার্থ থেকে এবং উদ্ভবের পর থেকেই সেগুলো অপ্রতিরোধ্যভাবে অধিক জটিল এবং নিখুঁত প্রজাতি হওয়ার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

ডারউইন এই সরলরৈখিক বিকাশকে প্রত্যাখান করেন এবং বলেন যে, প্রজাতির বিকাশ সরলরৈখিক নয় বরং শাখাবহুল। যেখানে কিছু প্রজাতি একই পূর্বপুরুষ থেকে জন্ম নিয়ে ভিন্ন পথে যাত্রা করে। এই ধারণা বিদ্যমান ধারণার পুরোপুরি বিপরীত ধরনের। প্রচলিত ধারণায় মনে করা হতো যে, নতুন একটি প্রজাতি তার পূর্বপুরুষ থেকে কতখানি আলাদা হতে পারে তার একটি নির্দিষ্ট সীমা আছে।


একই পূর্বপুরুষ থেকে শাখাময় বংশধারার বিবর্তন তুলনামূলকভাবে খুব কম সময়ে গৃহীত হয়ে যায়, কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেটি অত সহজ ছিল না। সাধারণ লোকতো দূরের কথা, এমনকি বৈজ্ঞানিক সমাজেও তা গৃহীত হয়নি শুরুতেই। না হওয়ার কারণটাও বোধগম্য। ডারউইন নিজেই উত্তরাধিকারের মেকানিজমকে ব্যাখ্যা করতে পারেন নাই। এক ধরনের কাল্পনিক ‘gemmules’  এর কথা বলেছেন যা টিস্যু থেকে উপত্তি হয়ে সেক্স অর্গানে যায় এবং সেখানে অনুরূপ তৈরি হবার পরে সেগুলো পরবর্তী প্রজন্মসমূহে স্থানান্তরিত হয়। বিংশ শতাব্দীর তিরিশ এবং চল্লিশের দশকে এসে প্রাকৃতিক নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া শুরু করে। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনকে জেনেটিকসের পথিকৃত গ্রেগর মেণ্ডেলের তত্ত্বের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। অরিজিন অব স্পিসিসের জন্মের একশ’ বছরের মধ্যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব তার অবস্থান নিশ্চিত করে ফেলে।

আধুনিক চিন্তাধারায় ডারউইনের প্রভাব

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বজগত সম্পর্কে আমাদের ধারণা উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কে দায়ী সে বিষয়ে কোন ঐক্যমতে আসা যায় না। কেউ কেউ বলেন কার্ল মার্ক্সের কথা, কেউ বা বলেন সিগমণ্ড ফ্রয়েডের কথা। আবার কেউ বা বলেন আইনস্টাইনের কথা।

কিন্তু জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গেলে এই সংশয় আর থাকে না বিন্দুমাত্র। গত দেড়শ’ বছরে অনেক জীববৈজ্ঞানিক ধারণা প্রস্তাবিত হয়েছে যেগুলো মানুষ যেভাবে সত্যকে দেখতো তার সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই ধারণাগুলোকে মেনে নেওয়ার জন্য একটা আদর্শিক বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল। চার্লস ডারউইনের মত এমন গড়পড়তা মানুষের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি এমন সুতীব্রভাবে পরিবর্তন আর কেউ করতে পারেনি।

ডারউইনের অবদান এমন বিপুল এবং ব্যাপক যে, তিনটি প্রধান ভাগে তার অবদানকে ভাগ করা যেতে পারে। সেগুলো হচ্ছে; বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান, বিজ্ঞানের দর্শন এবং আধুনিক চিন্তাধারা।

ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি

ডারউইন প্রাণ বিজ্ঞানের নতুন একটি শাখার জন্ম দেন। তা হচ্ছে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান। বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানে তার চারটি অবদান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি হচ্ছে প্রজাতির পরিবর্তনীয়তা, বা যাকে বলা যেতে পারে বিবর্তনের আধুনিক ধারণা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে শাখাময় বিবর্তনের ধারণা। এর অর্থ হচ্ছে এই পৃথিবীর সকল প্রাণীরই আদি উৎস এক। ১৮৫৯ সালের আগ পর্যন্ত জ্যা ব্যাপ্টিস্ট ল্যামার্কসহ সকল বিবর্তনীয় প্রস্তাবই সরলরৈখিক বিবর্তনকে সমর্থন দিয়েছে। ডারউইন আরো যোগ করেছিলেন যে বিবর্তন অবশ্যই ক্রমিক (gradual)। এতে বড় ধরনের কোন বিঘ্ন বা অধারাবাহিকতা নেই। সবশেষে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, বিবর্তনের উপায় (mechanism) হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন।

এই চারটি অন্তর্জ্ঞানই ডারউইনকে বিজ্ঞানের দর্শনের নতুন শাখা জীববিজ্ঞানের দর্শন তৈরিতে মূল ভূমিকা পালন করেছে। যদিও পূর্ণ বিকশিত হতে এই দর্শনের একশ’ বছর লেগে গেছে। তবে মূল ধারণা গড়ে উঠেছে ডারউইনের কনসেপ্ট থেকেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ডারউইন বিজ্ঞানে ঐতিহাসিকতার প্রবর্তন করেছিলেন। পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নের বিপরীতে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান ঐতিহাসিক বিজ্ঞান। বিবর্তনবাদীরা ইতোমধ্যেই ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। এই ঘটনা এবং প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করার জন্য সূত্র বা পরীক্ষণ যথাযথ কৌশল নয়। তার বদলে কোন একটি নির্দিষ্ট সিনারিওর পরীক্ষামূলক পুনর্নির্মাণ সহযোগে ঐতিহাসিক বর্ণনা তৈরি করা হয় সেই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য।

উদাহরণস্বরূপ, পৃথিবী থেকে হঠা করে ডাইনোসরের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পিছনে তিনটি ব্যাখ্যা প্রস্তাব করা হয়েছিল। মহামারী, জলবায়ুর হঠাৎ করে ব্যাপক পরিবর্তন এবং উল্কাপিণ্ডের প্রভাব, যাকে আলভারেজ তত্ত্ব (Alvarez theory) বলা হয়। প্রথম দুটো বর্ণনাই শেষ পর্যন্ত বাতিল করে দেওয়া হয় এর স্বপক্ষে কোন প্রমাণাদি না থাকায়। সব জানা তথ্য সমূহই আলভারেজ তত্ত্বকে সায় দেয়। ঐতিহাসিক বর্ণনার পরীক্ষণ যা বলতে চায় তা হচ্ছে, বিজ্ঞান এবং মানবিকের মধ্যে যে সুদূরপ্রসারী ব্যবধান ছিল তা আসলে অবিদ্যমান। এর মেথডোলজি এবং পরিবর্তন ঘটানো সম্ভবকারী সময় ফ্যাক্টরকে গ্রহণ করার ফলে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান এদের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসাবে কাজ করে।

ডারউইন এবং ওয়ালেসের প্রাকৃতিক নির্বাচন আবিষ্কার ছিল বড় ধরনের দার্শনিক অগ্রযাত্রা। দর্শনের ইতিহাসে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মূলনীতিগুলো এর আগে দুই হাজার বছর ধরে অজানা ছিল। প্রাকৃতিক নির্বাচনের অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে অভিযোজিত পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে। এর ধরন খুবই সহজ সরল। অনুন্নত প্রজাতিসমূহকে লুপ্ত করে দেয়াই এর পদ্ধতি। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে অনুন্নত প্রজাতিকে লুপ্ত করে দেয়ার ধারণাকে ডারউইনের সমসাময়িক দার্শনিক হার্বার্ট স্পেনসার ‘যোগ্যতম টিকে থাকবে’ এই বিখ্যাত বাক্যের মাধ্যমে বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তবে এই উক্তি দীর্ঘদিন চক্রাকার যুক্তি হিসাবে হাসি ঠাট্টার শিকার হয়েছে। ‘যোগ্যতম কে? যারা টিকে থাকে’। বাস্তবে, খুব সতর্কভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে কেন কিছু বিশেষ পরিবেশে কিছু কিছু প্রজাতি টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়।

প্রাকৃতিক নির্বাচনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে এটি ঐশ্বরিক চুড়ান্ত কারণকে অপ্রয়োজনীয় করে ফেলেছে। কোন কিছুই আর পূর্ব নির্ধারিত নয় এখন। এমনকি, নির্বাচনের উদ্দেশ্যও পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে সাথে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পালটে যেতে পারে।

প্রাকৃতিক নির্বাচন ঠিকঠাকভাবে কাজ করার জন্য বৈচিত্র্যময় প্রজাতিসমূহের সমাহার প্রয়োজন। বৈচিত্র্যের গুরুত্ত্বের কারণে প্রাকৃতিক নির্বাচনকে দ্বিস্তর বিশিষ্ট প্রক্রিয়া হিসাবে বিবেচনা করা হয় ব্যাপক বৈচিত্র্যের সমাহারের পরেই আসে অনুন্নত প্রজাতির বিলুপ্তি। পরের ধাপটি সুনির্দিষ্ট। প্রাকৃতিক নির্বাচনকে গ্রহণ করার মাধ্যমে ডারউইন দৈবতা না প্রয়োজনের কারণে পরিবর্তন হয় সে বিষয়ে দার্শনিকদের মধ্যে কয়েক হাজার বছর ধরে চলে আসা বিতর্ককে সমাধান করতে সক্ষম হন। প্রজাতির পরিবর্তন দু’টো কারণেই হয়ে থাকে। প্রথম পর্যায় হচ্ছে এলোপাতাড়িভাবে (Randomly) এবং দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে প্রয়োজনের তাগিদে।

ডারউইনীয় চিন্তা-ভাবনা

একবিশ শতাব্দীর একজন মানুষ ভিক্টোরিয়ান যুগের কোন মানুষের চেয়ে ভিন্নভাবে পৃথিবীকে দেখে থাকে। এই দৃষ্টিঙ্গিগত পরিবর্তনের পিছনে অনেক কারণ রয়েছে বিশেষ করে টেকনোলজির অবিশ্বাস্য ব্যাপক পরিবর্তনের ভুমিকা অনেকখানিই । কিন্তু চিন্তাধারার এই ব্যাপক পরিবর্তনের পিছনে যে ডারউইনের ধারণাসমূহের বিশাল ভূমিকা রয়েছে তাকে স্বীকার করা হয়নি তেমন করে

১৮৫০ সালে সকল প্রথিতযশা বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকেরা ছিলেন খ্রীষ্টান লোক। যে পৃথিবীতে তারা বসবাস করতেন তা সৃষ্ট হয়েছে ঈশ্বর কর্তৃক। প্রাকৃতিক ধর্মতাত্তত্বিকেরা মনে করতেন যে,  ঈশ্বর তার বিচক্ষণ সূত্রসমূহের মাধ্যমে সকল প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণীর একে অপরের সাথে এবং পরিবেশের সাথে নিখুঁত অভিযোজনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ডারউইনের প্রস্তাবিত মৌলিক সূত্রসমুহীরকম বিদ্যমান ধারণার সাথে একেবারে বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করে।

প্রথমতঃ ডারউইনবাদ সকল অলৌকিক প্রপঞ্চ এবং কার্যকারণকে বাতিল করে দেয়। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের তত্ত্ব প্রাণীজগতের অভিযোজন এবং বৈচিত্র্যতাকে একেবারে বস্তবাদী উপায়ে ব্যাখ্যা করেছে।  এতে আর ঈশ্বর নামক কোন সৃষ্টিকর্তা বা ডিজাইনারের কোন প্রয়োজন নেই। ডারউইন নির্দেশ করেন যে, বাইবেল বা অন্যান্য ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থে সৃষ্টির যে বর্ণনা দেওয়া আছে তা প্রাকৃতিক জগতের সাথে সম্পূর্ণ বিরোধপূর্ণ। প্রাকৃতিক ধর্মতাত্ত্বিকদের মুগ্ধাবিষ্ট ‘বিস্ময়কর ডিজাইনের’ সকল দিককেই প্রাকৃতিক নির্বাচন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। বিজ্ঞান থেকে ঈশ্বরকে আলাদা করে ফেলার ফলে সকল প্রাকৃতিক প্রপঞ্চের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। এর ফলে বৈজ্ঞানিক জগতে অত্যন্ত শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আত্মিক বিপ্লবের সৃষ্টি হয় যার প্রভাব এখন পর্যন্ত রয়ে গেছে।

দ্বিতীয়তঃ ডারউইন টাইপোলজিকে খণ্ডন করেছেন। পীথাগোরাস এবং প্লেটোর সময় থেকেই প্রাণী জগতের বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে ঐক্য এবং সুস্থিতিতার উপর জোর দেওয়া হতো। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বলা হয়, টাইপোলজি বা অপরিহার্যবাদ (Essentialism)। যে বৈচিত্র্য আছে প্রাণী জগতে এবং উদ্ভিদ জগতে তা খুবই সামান্য কিছু প্রাকৃতিক ধরনের এবং এই ধরনগুলোই এক একটি শ্রেণী গঠন করে। একই শ্রেণীর সদস্যদেরকে হুবহু অনুরূপ এবং ধ্রুব এবং তারা অন্য শ্রেণীর সদস্যদের থেকে প্রচণ্ডভাবে আলাদা বলে মনে করা হতো।

ডারউইন এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বাতিল করে দেন এবং সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ধারণা প্রবর্তন করেন। মানুষসহ সকল জীবিত প্রাণী বা উদ্ভিদের সকল গ্রুপের সদস্যা যার যার মতো আলাদা। ছয় বিলিয়ন লোকের মধ্যে এমন কোন দুইজন লোককেই পাওয়া যাবে না যারা হুবহু অনুরূপ।

তৃতীয়তঃ ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব সকল ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপকেই অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে। গ্রীকদের সময় থেকেই সার্বজনীন একটা বিশ্বাস ছিল যে, ঐশ্বরিক শক্তি সবকিছুকেই অধিকতর  নিখুঁততার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এরিস্টটল এরকম একটি কারণ হিসাবে ‘চুড়ান্ত কারণের’ কথা উল্লেখ করেছেন। কান্টও (Kant) নিউটোনিয়ান পদার্থবিদ্যার সূত্র দিয়ে জীববৈজ্ঞানিক প্রপঞ্চকে ব্যাখ্যা করার অসফল চেষ্টা করেছিলেন। ১৮৫৯ সালের পরেও বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানে ঐশ্বরিক ব্যাখ্যা জনপ্রিয় ছিল। ডারউইনবাদ এসে এই সমস্ত ধ্যান ধারণাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেয়।

চতুর্থতঃ ডারউইন ডিটারমিনিজমকেও বিদায় করে দেন। লাপ্লাস ( Laplace) মনে করতেন যে, বর্তমান বিশ্বজগত এবং এর প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকলে অসীম ভবিষ্যত সম্পর্কেও ভবিষ্যতবাণী করা সম্ভব। এর বিপরীতে ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া জুড়ে এলোপাতাড়িময়তা এবং দৈবতাকে গ্রহণ করেছেন। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় দৈবের কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে সেটা অনেক পদার্থবিদের কাছেই অগ্রহণযোগ্য ছিল। আইনস্টাইন ‘ঈশ্বর পাশা খেলে না’ এই বক্তব্যের মাধ্যমে দৈবের প্রতি তার অনীহাকে প্রকাশ করে গেছেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রথম ধাপ, বৈচিত্র্যতার সৃষ্টি পুরোপুরি দৈবের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপ, প্রকৃত নির্বাচন সম্পূর্ণ সুনির্দিষ্ট।

পদার্থবিদ এবং দার্শনিকদের প্রাথমিক বাধা সত্ত্বেও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় আকস্মিক ঘটনার এবং দৈবের ভূমিকা সার্বজনীনভাবে গৃহীত। অনেক জীববিজ্ঞানী এবং দার্শনিকেরা জীববিজ্ঞানে সার্বজনীন সূত্রের অবস্থানকে অস্বীকার করেন।

পঞ্চমতঃ ডারউইন বলেন যে সৃষ্টিজগতে মানুষ কোন বিশেষ সৃষ্টি না। আর এর মাধ্যমে তিনি নতুন ধরনের মানবকেন্দ্রিকতা তৈরি করেন। তার সমসাময়িক লোকদের ডারউইনের মতবাদের যে অংশটা মানতে কষ্ট হয়েছিল তা হচ্ছে অন্যান্য প্রাণীর মত মানুষের ক্ষেত্রেও একই পূর্বপুরুষের ধারণা ব্যাখ্যা করা। ধর্মতাত্ত্বিক এবং দার্শনিকদের মতে, মানুষ ছিল সৃষ্টিজগতের অন্য প্রাণীর থেকে আলাদা এবং শ্রেষ্ঠতর। এরিস্টটল, ডেকার্টে এবং কান্ট অনেক কিছুতেই একমত না হলেও এই বিষয়ে পুরোপুরি একমত ছিলেন। কিন্তু জীববিজ্ঞানী টমাস হাক্সলি (Thomas Huxley) এবং আর্নস্ট হ্যাকেল (Ernst Haeckel) ব্যাপক তুলনামূলক পরীক্ষণের মাধ্যমে দেখান যে, মানুষ এবং এপের পূর্বপুরুষ একই। তাদের এই ধারণা পরবর্তীতে আর কখনোই বিজ্ঞানে প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। একই পূর্বপুরুষের তত্ত্ব মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগের ফলে প্রাণীজগতে মানুষের আগের যে বিশেষ মর্যাদা ছিল তা নড়ে গেছে সন্দেহাতীতিভাবেই।

যদিও এর মানে এই নয় যে, এর ফলে মানবকেন্দ্রিকতা একেবারে শেষ হয়ে গেছে। মানুষের উপর গবেষণায় দেখা গেছে যে, এর উৎপত্তি একই পূর্বপুরুষ থেকে হওয়া সত্ত্বেও সকল প্রাণীর মধ্যে এর বৈশিষ্ট্য অনন্য। যে কোন প্রাণীর চেয়ে মানুষের বুদ্ধিমত্তা অনেক অনেক বেশি। মানুষই একমাত্র প্রাণী যার ব্যাকরণ এবং বাক্যরীতি সহযোগে ভাষা আছে। ডারউইনের মতে একমাত্র মানুষই প্রকৃত নৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। উচ্চ বুদ্ধিমত্তা, ভাষা এবং দীর্ঘকাল সন্তানের যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা সমৃদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। ভাল হোক বা মন্দ হোক এর মাধ্যমেই মানুষ গোটা পৃথিবীতে একচ্ছত্র আধিপত্য গড়ে বিস্তার করেছে।

ষষ্ঠতঃ ডারউইন নৈতিকতার একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রদান করেছেন। সবসময়ই প্রশ্ন তোলা হয় যে, বিবর্তন কি মানুষের নৈতিকতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে কিনা। অনেকেরই ধারণা যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন যদি কোন ব্যক্তির শুধুমাত্র নিজের অস্তিত্ব রক্ষা এবং প্রজননের সাফল্যকে বৃদ্ধি করার আত্মকেন্দ্রিক আচরণকে পুরস্কৃত করে থাকে তবে সেই ধরনের আত্মকেন্দ্রিক আচরণ কোন নৈতিকতা সৃষ্টি করতে পারে কিনা? হার্বার্ট স্পেনসার কর্তৃক বিকশিত সোস্যাল ডারউইনিজম অনুযায়ী নৈতিকতার বিকাশের ক্ষেত্রে বিবর্তনীয় ব্যাখ্যা অচল।

আজকে আমরা জানি যে, সামাজিক প্রজাতির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ব্যক্তি নয় বরং গোটা সামাজিক দলই নির্বাচনের লক্ষ্য হতে পারে। ডারউইন ১৮৭১ সালে এই যুক্তিটাই মানব প্রজাতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন। একটি সামাজিক দলের অস্তিত্ব রক্ষা এবং সমৃদ্ধি সেই দলের সদস্যদের মধ্যে সুসমন্বিত সহযোগিতার উপর অনেকখানি নির্ভর করে। এই সহযোগিতা পরার্থবাদেরও (Altruism) উপর নির্ভর করে। এই পরার্থবাদ দলের টিকে থাকা এবং সমৃদ্ধিতে সহযোগিতা করার সাথে সাথে দলের সদস্যদের যোগ্যতা বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।

দল নির্বাচন এবং পারস্পরিক সহযোগিতা সামাজিক দলকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে। অন্যান্য সামাজিক প্রাণীসমূহের মধ্যে ঐ ধরনের পরার্থবাদ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গেছে। সামাজিক দলের মধ্যে পরার্থবাদের আধিক্য এবং সুসমন্বিত সহযোগিতাকে নির্বাচন পক্ষপাত দেখায়। এর মধ্য দিয়েই যে কেউ বিবর্তন এবং নৈতিকতার সম্পর্ক দেখাতে পারে। সোস্যাল ডারউইনের পুরনো ধারণা প্রাণী, বিশেষ করে সামাজিক প্রাণীসমূহের উপর অসম্পূর্ণ ধারণা থেকে গড়ে উঠেছিল।

বিবর্তনের সমর্থন

ডারউইনের তত্ত্ব যতই বৈপ্লবিক হোক না কেন একে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে যেমন সমস্যা ছিল এখনো সেই রকমই সমস্যা রয়ে গেছে। ২০০৬ সালে পরিচালিত গ্যালুপ পরিচালিত এক জরীপে দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১৪ শতাংশ লোক একমত যে, মানুষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের মাধ্যমে জন্মেছে। এই হার ১৯৮২ সালে ছিল মাত্র ৯ শতাংশ। বিবর্তনকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে দেশে দেশেও বিভেদ রয়েছে। বিবর্তনের প্রতি সবচেয়ে পক্ষপাত রয়েছে আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক এবং সুইডেনের। কোন দেশের লোকজনের ঈশ্বর বিশ্বাসের সাথে বিবর্তনে বিশ্বাস বিপরীতমুখী সহসম্পর্কযুক্ত।


চিত্র ১: বিবর্তনের সমর্থন দেশে দেশে 
তবে এখানে মজার একটা বিষয় রয়েছে। বিবর্তনের উপর গবেষক গ্রেগরী পল এবং পিটজার কলেজের সমাজবিজ্ঞানী ফিল জুকারম্যান যুক্তি দিয়েছেন যে, ঈশ্বরে বিশ্বাস করা দেশের লোকের টিকে থাকার সংগ্রামের মাত্রার সাথে বিপরীতমুখী সহ-সম্পর্কযুক্ত। যে সমস্ত দেশে খাদ্যের প্রাচুর্য রয়েছে, স্বাস্থ্য সেবা সার্বজনীন এবং বসতবাটি সহজলভ্য সেখানে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস যে সমস্ত দেশে ওই বিষয়গুলো অনিশ্চিত তার চেয়ে কম।

Friday, November 20, 2015

জয় আমাদের হবেই


.

মানবতাবিরোধী মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর প্রথম দিকে ট্রাইব্যুনালের বিচারককে হুমকি দিয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দম্ভোক্তি করেছিলেন যে, 'চোখ রাঙাবেন না। আমি রাজাকার। আমার বাপ রাজাকার। এখন কে কী করতে পারেন করেন।'

আদালত কী করতে পারে, তা এখন সবাই দেখছে। ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সালাউদ্দিন কাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলওই রায়ে বিরুদ্ধে আপিল করেন এই বিএনপি নেতা। চলতি বছরের ২৯ জুলাই আপিল বিভাগ সালাহউদ্দিন কাদেরের আপিল খারিজ করে দিয়ে ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখে। পরে এ রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। সবশেষ গতকাল বুধবার তার রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছে।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এই দম্ভের কথা তাঁর বিচারের পূর্ণাঙ্গ রায়তেও লিখে রেখেছেন বিচারকেরা। সেখানে বলা হয়েছে, বিচারের কোনো পর্যায়েই তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য অনুশোচনা এবং অনুতাপ দেখান নি, বরং এই আদালতের বিচারকাজকে অবমাননা এবং উপেক্ষা করেছেন। তাঁর হাবভাবকে ট্রাইবুনাল দম্ভ হিসাবে দেখেছে এবং বার বার সতর্ক করার পরেও তিনি পুরো বিচার প্রক্রিয়া চলার সময়েই চিৎকার-চেচামেচি করে ট্রাইবুনালের সৌষ্ঠবকে নষ্ট করেছেন। ট্রাইবুনালের কর্মকর্তাদের প্রতি কোনো সম্মান তিনি প্রদর্শন করেন নি এবং ট্রাইবুনালের কর্তৃত্বকে অমান্য করে গিয়েছেন প্রতিনিয়ত।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর শুধু একার নয়, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসির আদেশের রিভিউ আবেদনও খারিজ হয়ে গিয়েছে একই সাথে

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত এখন ফাঁসি দেবার জন্য জল্লাদরাও প্রস্তুত প্রস্তুত বাংলাদেশের মানুষেরাও। চুয়াল্লিশ বছর আগে মানবতার বিরুদ্ধে যে নিষ্ঠুর অপরাধ সংঘটিত হয়েছিলো, তার কিছুটা পাপমোচন হতে যাচ্ছে এর মাধ্যমে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে আবদুল কাদের মোল্লা এবং মোঃ কামরুজ্জামানের ফাঁসি হয়েছে। এঁরা দুজনও সেই একই পথের পথিক হতে যাচ্ছেন খুব শীঘ্রই।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত তেইশটি অপরাধের অভিযোগ আনা হয় যারা মধ্যে নয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।

এর চারটিতে মৃত্যুদন্ড এবং পাঁচটিতে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছিলো তাঁকে
এইসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের রাউজানে কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহ ও হাটহাজারীর একজন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মোজাফফর হোসেনকে তার পুত্রসহ হত্যা, এবং একাধিক এলাকায় গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও দেশত্যাগে বাধ্য করার ঘটনা।

অন্যদিকে আলী আহসান মুজাহিদ ছিলেন কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর প্রধান। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেই বছর জানুয়ারিতে ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি হন মুজাহিদ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর জুলাই মাসে সংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারি এবং এরপর প্রাদেশিক সভাপতির দায়িত্ব পান।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠিত হলে, ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার নেতৃত্ব দেন ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার সভাপতি ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী। অক্টোবরে ওই বাহিনীর প্রধান হন মুজাহিদ।

তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মুজাহিদের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী যুদ্ধের মধ্যে ফরিদপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায়। মুজাহিদের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী সেপ্টেমর মাস থেকে শুরু করে দেশ স্বাধীন হবার আগ পর্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে এ দেশের বরেণ্য সব বুদ্ধিজীবীদের। 


.

আজকে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার হচ্ছে, এর ভিত্তিটা কিন্তু গড়ে দিয়েছিলেন এক অসমসাহসিক নারী জাহানারা ইমাম। একটা সময়ে প্রায় সবাই যখন একাত্তরের কথা ভুলতে বসেছে, বাংলাদেশের সমাজে যুদ্ধাপরাধীরা যখন শক্ত ভিত গেড়ে বসেছে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষেরা যখন কোণঠাসা, ঠিক সেই সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় আন্দোলনটা গড়ে তুলেছিলেন তিনিভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিচারের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে বার্ট্রান্ড রাসেলে একটি বেসরকারী ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন। সেই ট্রাইব্যুনালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং উত্তর ভিয়েতনামে গুপ্তহত্যার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জনসনের সরকারকে দায়ী করা হয়। এরই আদলে জাহানার ইমাম ১৯৯২ সালের ২৬শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গড়ে তোলেন গণ আদালত। সেখানে প্রতীকী বিচারকার্য সমাধা হয় গোলাম আযমসহ কুখ্যাত বেশ কিছু রাজাকারের। এই গণআদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য সারা দেশব্যাপী এক বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তিনি।

পচাত্তরের পরে আমাদের ইতিহাসকে বিকৃত করার, আমাদের গৌরবোজ্জল উত্তরাধিকারকে কালিমালিপ্ত করার, ইতিহাসের সাহসী মানুষদের বিস্মৃতির আঁধারে ঠেলে দেবার, খলনায়কদের নায়ক বানানোর সব প্রচেষ্টাই চালু হয়ে যায়। একসময় যারা বাংলাদেশের জন্মে প্রবল বিরোধিতা করেছে, নিদারুণ নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছে একে আঁতুরঘরেই হত্যা করতে,  একাত্তরের সেইসব যুদ্ধাপরাধীরা তখন সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো কোনো কণ্ঠ তখন বাংলাদেশে ছিলো না। অদম্য সাহস নিয়ে মহিয়সী এই মহিলা এগিয়ে আসেন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে। সেই সময় তিনি মরণব্যাধী ক্যান্সারে আক্রান্ত। মৃত্যুকে সঙ্গী করে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন তিনি। বিএনপি-জামাত এবং ফ্রিডম পার্টিওয়ালাদে অকথ্য গালিগালাজ খেয়েছেন। বিএনপি সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটেও থেকেছেন। তারপরেও তাঁকে ঠেকানো যায় নি। নির্মূল কমিটির জেলা বা থানা পর্যায়ের আয়োজিত যে কোন জনসভাতেই অংশ নিতেন তিনি। ফলে আন্দোলন হয়ে উঠেছিল দুরন্ত-দুর্বার।

গণ আদালত গঠন করার অপরাধে তাঁকে সহ চব্বিশজনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় ফেলে দেয় বিএনপি সরকার। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপবাদ মাথায় নিয়েই মারা যান তিনি। কী আজব এই দেশ! অথচ এই ভদ্রমহিলা মানব ইতিহাসের বিরল এক মা। একাত্তরে বাংলাদেশের যাতে জন্ম হয় সেই কারণে নিজ হাতে সন্তানকে রণসাজে সাজিয়ে ভারতের পথে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলেন তিনি যুদ্ধে যাওয়া তাঁর সেই ছেলে রুমি বাঁচে নি। আরো অসংখ্য গেরিলা যোদ্ধার সাথে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো তাঁকে। শুধু যে ছেলে হারিয়েছিলেন তিনি, তাই নয়। তাঁর স্বামীও মারা গিয়েছিল এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ স্পর্শে। আর সেই দেশে তিনি রাষ্ট্রদোহী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন!

মৃত্যুকে বিছানার একেবারে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখার পরেও তিনি তাঁর কর্তব্য কর্মে অবিচল ছিলেন। মারা যাবার আগে দেশবাসীকে উদ্দেশ্য করে শেষ চিঠি লিখে যান তিনি। সেই চিঠিতেও আশংকা প্রকাশ করে গিয়েছিলেন এই বলে যে, এই আন্দোলনকে এখনো অনেক দুরস্ত পথ পাড়ি দিতে হবে। তাঁর মৃত্যুর এতদিন পরেও দেখা যাচ্ছে যে, তাঁর কথাই সত্যি ছিল। এই আন্দোলনকে অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে ধীরে ধীরে সাফল্যের মুখ দেখতে হচ্ছে।

জাহানারা ইমামের লেখা শেষ চিঠিটা ছিলো এরকম

সহযোদ্ধা দেশবাসীগণ,

আপনারা গত তিন বছর একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এই লড়াইয়ে আপনারা দেশবাসী অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের অঙ্গীকার ছিল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাবো না। মরণব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ মরণ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আরেকবার আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা, আমার সন্তান সন্ততিরা আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবে।

এই আন্দোলনকে এখনো অনেক দুরস্ত পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও যুবশক্তি, নারীসমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি জনগণের মত বিশ্বস্ত আর কেউ নেই। জনগণই সকল শক্তির উৎস। তাই একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় আন্দোলনের দায়িত্বভার আমি আপনাদের বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম।

জয় আমাদের হবেই।

জাহানার ইমামের দেখানো সেই পথ ধরেই আজ এতো দিন পর একে একে সব কুখ্যাত রাজাকার-আলবদরদের বিচার হচ্ছে এই বাংলাদেশে। যে বাংলাদেশকে একদিন আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম এদের হিংস্র নখরাঘাতে, সেই বাংলাদেশকে যেনো ফিরে পাচ্ছি ধীরে ধীরে।


আমাদের আগের প্রজন্ম তাদের প্রথম তারুণ্যে ভালবাসার রমণীর হাত ধরার আগেই দেশ মাতৃকার দুর্দিনে হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্রএকটা প্রজন্মের অসংখ্য তরুণ জানে নি কেমন লাগে ভালবাসার মানুষের চোখে চোখ রাখতে, কী রকম অনুভূতি হয় নিজের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে, কী ধরনের আনন্দে মানুষ ভেসে যায় নাতি নাতনির হাত ধরে হাঁটার সময়তার আগেই দেশ আর দেশের মানুষের জন্য সব ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল তারা তারা চলে গিয়েছে, কিন্তু আমাদের দিয়ে গিয়েছে স্বাধীন একটা দেশ সেই দেশটাকে, একদল হিংস্র শকুন-শ্বাপদের কাছে হেরে তাদের অভয়ারণ্য হতে দিতে পারি না আমরা কিছুতেই। এ লড়াইয়ে জয় আমাদের হবেই। শুধু প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ থাকা।

জয় বাংলা



Sunday, November 15, 2015

ব্যাপ্টিজম অব দ্য ক্রাইস্ট

শিল্পকলার নানা শাখায় গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যতোটা না শেখা যায়, এই সকল শাখায় গুরুর কাছ থেকে ছাত্ররা তার চেয়ে বেশি শিখে নিতে পারে। চিত্রশিল্পও এর ব্যতিক্রম নয়। এই শাখায় গুরু-শিষ্যের সম্পর্কটা বেশ প্রাচীনই।

মধ্যযুগের ইউরোপ যেখানে ছিল রোগ-শোক এবং যুদ্ধবিগ্রহের আখড়াভূমি, নতুন কোন আবিষ্কারের জন্য একেবারে বন্ধ্যা ক্ষেত্র। সেখানে রেঁনেসা ছিল একেবারেই মুদ্রার অপর পিঠ। সাগ্রহে অংশ নেওয়ার সময়, নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশায় কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়। নিজেদের সামর্থ্য কী সে সম্পর্কে সচেতনতা এবং সভ্যতা যা অর্জন করেছে তার চেয়েও বেশী করার সামর্থ্য রাখে এই বিশ্বাসই নাড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপকে। এরফলশ্রুতিতেই শুরু হয় নতুন নতুন আবিষ্কার এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তার সূত্রপাত।সেই সাথে শৈল্পিক উৎকর্ষের জন্য তৈরি হয় উর্বর ক্ষেত্র।

ইউরোপে রেনেসার সময়ে চিত্রশিল্পে নতুন পদ্ধতি এবং প্রকরণ প্রয়োগের জোয়ার আসে। ছবি এঁকে তখন সম্মান ও প্রতিপত্তি অর্জন করাতো যেতোই, সেই সাথে সুন্দর করে জীবিকাও নির্বাহ করা যেতো। জ্ঞানের নানা শাখায় উন্নতি হওয়ার কারণে জনসাধারণের রুচিও উন্নত হয়ে ওঠে। সুকুমার বৃত্তি এবং শিল্পকলার প্রতি মানুষের অনুরাগ এবং ভালবাসা বৃদ্ধি পায় প্রচুর পরিমাণে। ফলে, ভালো ছবির কদর যায় বেড়ে। মানুষজন টাকা পয়সা খরচ করে সেগুলো কিনতে দ্বিধাবোধ করতো না। এই সহজলভ্য টাকা এবং দ্রুত প্রাপ্য সম্মানের লোভে অসংখ্য প্রতিভাবান শিল্পী চলে এসেছিলেন চিত্র শিল্পে নিজেদের পেশা সুদৃঢ় করতে।

এই স্বর্ণ সময়ে ইতালির নানা শহরে গড়ে উঠেছিলো অসংখ্য ছোট-বড় নানা ধরনের স্টুডিও। এই সব স্টুডিওতে শিক্ষানবিশ শিক্ষার্থীরা গুরুর তত্ত্বাবধানে ছবি আঁকা শিখতো। এতে যে শুধুমাত্র শিষ্যদেরই লাভ ছিলো তা নয়। এদেরকে শেখাতে গিয়ে গুরুরও লাভ হতো। প্রচুর পরিমাণে ফরমায়েশ থাকার কারণে গুরুর একার পক্ষে সব ছবি এঁকে শেষ করে ফেলা সম্ভব ছিলো না।

ফলে, গুরু কাজে লাগিয়ে দিতেন তাঁর শিষ্যদের। ছবির গুরুত্বপূর্ণ অংশের কাজ করে তিনি চলে যেতেন অন্য ছবি আঁকায়। শিষ্যরা অগুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো সমাপ্ত করতো গুরুর নির্দেশনা অনুযায়ী। শুধু যে গুরুর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে হতো সবসময়, তাও নয়। অনেক সময়ই স্বাধীনভভাবে কাজ করার জন্য শিষ্যরা গুরুর সদয় অনুমতি পেতো। এতে করে খুব দ্রুত তাদের হাত পাকতো, নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্মাতো এবং এই পেশার সবচেয়ে জরুরী যেটা, সেই প্রয়োজনীয় প্রচার পাওয়া হয়ে যেতো। ভবিষ্যতে শিল্পী হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য এর অবদান ছিলো অসামান্য।

প্রতিভাবান শিল্পী যাঁরা, তাঁরা বেশিদিন এক গুরুর সাথে থাকতেন না। প্রয়োজনীয় জ্ঞানটুকু সঞ্চিত হলেই তাঁরা সরে যেতেন গুরুর কাছ থেকে। এরপরে হয়তো যোগ দিতেন অন্য কোনো চিত্র শিল্পীর স্টুডিওতে। সেখান থেকে আবার অন্য কোথাও। সেই সময়ে নতুন কিছু শেখার আশায় নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে দূরবর্তী কোনো শহরে পাড়ি দিতেও ছাত্ররা দ্বিধা করতো না। এমনই এক অদম্য জ্ঞানস্পৃহা গড়ে উঠেছিলো সবার মাঝে।

এইসব শিক্ষানবিশ ছাত্রদের মধ্যে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিও ছিলেন। ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী আন্দ্রিয়া দেল ভেরোকিওর স্টুডিওতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ভেরোকিও শুধু চিত্রশিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভাস্করও। একই সাথে মেটাল ওয়ার্কের কাজও তিনি করতেন। তাঁর স্টুডিওতে লিওনার্দো ছাড়াও বতিসিনি, বতিসেলি এবং লরেঞ্জো দ্য ক্রেডির মতো ছাত্ররা ছিলো, যারা পরবর্তীতে নিজেরাই বিখ্যাত শিল্পী হয়েছেন।

সেটা ১৪৭৫ সাল। লিওনার্দোর বয়স মাত্র তেইশ বছর। ফ্লোরেন্সের একজন মঙ্ক স্যান স্যালভি, আন্দ্রিয়া দেল ভেরোকিওকে একটা ছবি এঁকে দেবার জন্য ফরমায়েশ করেন। বাইবেলের কাহিনি অবলম্বনে ব্যাপ্টিজম অব দ্য ক্রাইস্ট ছবিটি আঁকা শুরু করেন তিনি। কাঠের উপরে টেম্পারা ব্যবহার করে ছবিটি আঁকা শুরু হয়। ছবির মধ্যমণি যীশু। তাঁকে দীক্ষা দিচ্ছেন সেইন্ট জন। বাঁ পাশে দুজন দেবদুত হাঁটু পেতে বসে আছে। ছবির মূল অংশ ভেরোকিও আঁকলেন। তাঁরপর একেবারে বাঁদিকের দেবদুতকে আঁকার ভার দিলেন লিওনার্দোর উপরে।

তরুণ লিওনার্দো দেবদূতের ছবিটিকে এমনভাবে আঁকলেন যে, গুরুর অংশটা পুরোপুরি মার খেয়ে গেলো এর তুমুল ঔজ্জ্বল্য এবং উচ্চতর মানের কাছে। লিওনার্দোর আঁকা অংশটার দক্ষতার কাছে ভেরোকিওর অংশটাকে মনে হতে লাগলো খুবই সাদামাটা এবং গতানুগতিক। দেবদূতের সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভঙ্গী, মাথার জটিল নকশা, মস্তকাভরণ আঁকার কল্পনাশক্তি এবং এর শান্ত-সমাহিত, পবিত্র ভাব দেখলে সহজেই বোঝা যাবে যে অত্যন্ত উঁচু স্তরের একটা কাজ করে ফেলেছে লিওনার্দো। সেই সময় তেলরঙের কাজ নতুন মাধ্যম হিসাবে মাত্র চালু হয়েছে। লিওনার্দো তেলরঙে এই কাজটা করেছিলেন। ভেরোকিওর মতো এরকম একজন ঝাঁনু এবং দক্ষ চিত্রশিল্পীর কাজ ম্লান হয়ে গেলো, তাঁরই ছাত্র, সদ্য এক তরুণ, যে কিনা কাজ শিখছে তাঁর কাছে শিক্ষানবিশ হিসাবে।

এই ছবির এক্স-রে করে দেখা গেছে যে, ভেরোকিও দেবদূতের যে স্কেচ করেছিলেন, পরবর্তীতে লিওনার্দো আঁকা শেষ হবার পরে যে চিত্র দাঁড়িয়েছে, তার সাথে কোনো মিলই নেই। ভেরোকিওর আঁকা স্কেচকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। একজন অসামান্য প্রতিভাবান শিল্পী যে জীবনের শুরুতেও অন্যকে অনুসরণ না করে স্বকীয় রাস্তাতেই হাঁটতে চান, তার জ্বলন্ত প্রমাণ এটি। ছবিতে দু’জন দেবদূত রয়েছে। এ দুটোতে তুলনা করলেই পার্থক্যটা বোঝা যায়। লিওনার্দো দেবদুতের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছেন, সে গভীর আগ্রহ নিয়ে পুরো বিষয়টা দেখছে, এবং সমস্ত ব্যাপ্টিজম কর্মকাণ্ডের মধ্যে খুব স্বাভাবিকভাবেই একাত্ম হয়ে গিয়েছে। এর বিপরীতে ভেরোকিওর দেবদূত তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। চারপাশে কী ঘটছে সে বিষয়ে কোনো আগ্রহই তার নেই। মনে হচ্ছে উদাসী একজন সে।

নিজের এই অক্ষমতা মেনে নিতে পারেন নি ভেরোকিও। লজ্জায়, ক্ষোভে, দুঃখে, অপমানে ছবি আঁকাই বন্ধ করে দিলেন তিনি। মনোনিবেশ করলেন ভাস্কর্যে। ব্যাপ্টিজম অব দ্য ক্রাইস্টই ভেরোকিওর সর্বশেষ ছবি। আর কখনো রঙ তুলি স্পর্শ করেন নি তিনি। এটাই তাঁর আঁকা সর্বশেষ ছবি হয়ে থেকে গিয়েছে।

শিষ্যের কাছে পরাজিত হয়ে কোনো গুরু এভাবে সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়েছেন, এই নজির আর নেই কোথাও। লিওনার্দোর জীবনীকার ভাসারি, এই ঘটনাকে দেখেছেন অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে। তাঁর মতে, এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এখান থেকেই হাই রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়।

কেউ কেউ অবশ্য একে অতিরঞ্জন হিসাবেই চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের ভাষ্য হচ্ছে যে, চিত্র শিল্পের চেয়ে ভেরোকিওর ভাস্কর্য শিল্পে দক্ষতা অনেক বেশি ছিলো। সে কারণেই যে পেশায় তিনি অধিকতর সাফল্য অর্জন করতে পারবে বলে ভেবেছিলেন, সেটাতে মনোনিবেশ করেছিলেন। এর সাথে লিওনার্দোর আঁকা দেবদূতের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যাপ্টিজম অব দ্য ক্রাইস্ট ছবিটা, তার শেষ ছবি হওয়াটা নেহায়তই কাকতালীয় ঘটনা মাত্র।