Wednesday, December 9, 2015

রক্ত পলাশের রঙ




 ১.
পলাশের গায়ে আদরের একটা চাপড় লাগান তিনি। তারপর গভীর স্নেহে জিজ্ঞেস করেন, কিরে বেটা, পারবি না?
শীতের সকাল। রূপসা নদীর শান্ত জলে বাতাসের ধাক্কায় হঠাৎ করেই মৃদু ঢেউ জাগে। সেই ঢেউয়ের মাথায় উল্লাসে একটু নেচে নেয় পলাশ। এটাকে হ্যাঁ সূচক উত্তর ভেবে নিয়ে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দেখা দেয় তাঁর মুখে। সাব্বাস বেটা! এই না হলে কী আর বাপের বেটা তুই! আমরা বাপ-বেটা মিলে তিতুমিররে ছাতু বানিয়ে দেবো। তারপর সেই ছাতু গুলিয়ে দুজনে মজা করে খাবো। সিনা টান টান করে বলেন তিনি। ছাতু খেতে পারিসতো রে বেটা? নাকি বিস্বাদ লাগে? যা তোকে গুড় মিশিয়ে দেবো। ছোট মানুষ এমনি এমনি খেতে পারবি না। নিজের রসিকতায় নিজেই হাসেন তিনি আপন মনে ।
ইঞ্জিন রুমে, পাশেই কাজ করছিলো সারোয়ার। রুহুল আমিনের ইঞ্জিনের সাথে কথা বলা দেখে ঠোঁটের কোণে মৃদু একটা হাসি ফুটে ওঠে তারদেখেও না দেখার ভান করে সে। বদমেজাজের জন্য রুহুল আমিন বিখ্যাত। মোটামুটি সবাই তাঁকে ভয় পায়। কিন্তু, খাট্টা মেজাজের এই লোকটার মধ্যে যে শিশুর মতো সরল একটা মন লুকিয়ে আছে, পাশে বসে কাজ না করলে সেটা সে কোনোদিনই জানতে পারতো না। পলাশে ওঠার পর থেকেই লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আদুরে গলায় কথা বলে চলেছে গানবোটের ইঞ্জিনের সাথে অনর্গল। যেন বাচ্চা একটা ছেলের সাথে কথা বলছে সেকে জানে রুহুল আমিনের হয়তো বাড়িতে বাচ্চা কোনো ছেলে আছে। সেই ছেলের কথা ভেবেই হয়তো গানবোটকে ছেলে বানিয়ে কথা বলে। অন্যদিনের তুলনায় আজ অবশ্য একটু বেশিই কথা বলছে। সেটার বা কী কারণ, কে জানে?
কারণটা আর কিছুই নয়। অসম্ভব ফুরফুরে মেজাজে আছেন আজ তিনি। এরকম মেজাজে তিনি সাধারণত খুব কম সময়ই থাকেন। এখন পর্যন্ত যা যা করার কথা, ঠিক সেভাবেই অপারেশনগুলো সাফল্যজনকভাবে শেষ করে চলেছেন তাঁরা। তবে, এই সাফল্যের কারণেই মেজাজ এমন ফুরফুরে নয়।  তার কারণ ভিন্ন। খুলনা জেলের পাশ কাটিয়ে যখন আসছিলেন তাঁরা, স্থানীয় লোকজন ছুটে এসেছিলো নদীর পারে বাধ ভাঙার মতো করেবাংলাদেশের পতাকাবাহী যুদ্ধ জাহাজ দেখে সে কি আনন্দ তাদের। কেউ কেউ খুশিতে আত্মহারা হয়ে আকুল হয়ে কাঁদছে, কেউ উন্মাদের মতো লাফাচ্ছে, কেউ বা নদীর তীর ধরে ছুটে চলেছে গানবোটের পাশাপাশি। যেন আপনজন কেউ চলে যাচ্ছে পাশ কাটিয়ে। তাকে ধরতে হবে। বয়ষ্ক কেউ কেউ দুই হাত তুলে মোনাজাতও শুরু করে দিয়েছে। তাঁরাও অনেকদিন পর দেশের মানুষ দেখে আনন্দের বাধ ভেঙে ফেলেছিলেন। নাবিকরা সব ছুটে এসেছিল ডেকে। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে তীরের মানুষের হাত নাড়ার জবাব দিয়েছে সবাই হাসিমুখে দল বেঁধে গলার সমস্ত আওয়াজ জড়ো করে শ্লোগান দিয়েছে জয় বাংলাতীর থেকে মানুষ সমস্বরে তার প্রতিদান দিয়েছে তীব্র কণ্ঠে জয় বাংলা বলে। আত্মার সম্পর্ক বোধ হয় একেই বলে। 
২. 
তাঁরা যে বাহিনী নিয়ে খুলনার পাকিস্তান নৌঘাটি তিতুমির আক্রমণ করতে যাচ্ছেন, সেই বাহিনীটির নাম আলফা ফোর্স। ভারতীয় নৌবাহিনীর রণতরী পানভেল, বিএসএফ এর রণতরী চিত্রাঙ্গদা, আর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দুটি গানবোট পদ্মা আর পলাশ মিলে ফোর্স আলফা। চিত্রাঙ্গদা অবশ্য এই অপারেশনে যাচ্ছে না। নড়াচড়া আর গতিতে মন্থর বলে তাকে রেখে আসা হয়েছে মংলাতে। সবার সামনে রয়েহে পদ্মা, পলাশের যমজ বোন সে। মাঝে পলাশ আর একেবারে শেষে রয়েছে পানভেল।
সেপ্টেম্বর মাসেই গড়ে তোলা হয়েছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনী। এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন সামন্ত। তিনি একজন দক্ষ সাবমেরিনার। কোলকাতা পোর্ট অথরিটি থেকে প্রাপ্ত দুটো টাগবোটকে রূপান্তরিত করা হয়েছিলো গানবোটে। এর ডেককে পরিবর্তিত করে ইটালিয়ান এল/৬০ এন্টি এয়ারক্রাফট গান বসানো হয়েছিলো
আজকের এই আলফা ফোর্সেরও নেতৃত্বে রয়েছেন ক্যাপ্টেন সামন্ত। তিনি অবস্থান করছেন ভারতীয় রণতরী পানভেলে। 
৩. 
ভারতের হাসনাবাদ থেকে যাত্রা শুরু করেছিল ফোর্স আলফা। ভারতীয় অর্ডন্যান্স ম্যাপ অনুসরণ করে হিরণ পয়েন্ট হয়ে নানান অব্যবহৃত অলিগলি জলপথ ব্যবহার করে, রাত দুটোয় চলে আসে তা পশুর নদীর মুখের আকরাম পয়েন্টে। এই সময় রাডারে ধরা পড়ে দুটো জাহাজ দ্রুতগতি পালিয়ে যাচ্ছে সাগরের দিকে। কামানের আওতার বাইরে বলে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে ফোর্স আলফা। ধাওয়া করলে মূল অপারেশন ব্যাহত হবে। কাজেই, ইস্টার্ন কমান্ডের কাছে ফ্ল্যাশ মেসেজ পাঠিয়ে নিজের পথে এগিয়ে যেতে থাকে সে। ইস্টার্ন কমান্ড সামাল দিক ও দুটোকে।
মংলা পোর্টের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে ফোর্স আলফা। কিন্তু সেখানেও তেমন কিছুই করার থাকে না তাদের। মংলা পোর্ট এর মধ্যেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। আগেরদিন ভারতীয় বিমানবাহিনী হামলা চালিয়েছে এখানে। নর্থ পোল আর ওশেন এন্টারপ্রাইজ নামের দুটো জাহাজে তখনও আগুন জ্বলছে। এখানে সামান্য একটু প্রতিরোধ আসে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে। সেটাকে খুব সহজে দমন করে ফোর্স আলফা এগিয়ে চলে খুলনা শহরের দিকে। নৌবাহিনীর ঘাঁটি তিতুমির দখল করাই তার মূল উদ্দেশ্যে। এটা করতে পারলে গ্রাউন্ড ফোর্সের জন্য খুলনা দখল করা সহজসাধ্য হবে। এখান থেকেই পশুর নদীর নাম পরিবর্তন হয়ে রূপসা হয়ে গিয়েছে। গতি মন্থরতার কারণে চিত্রাঙ্গদাকে এখানেই রেখে দেওয়া হয়। খুলনার কাছেও লাইটনিং নামে একটা প্রায় ডুবন্ত জাহাজ চোখে পড়ে তাদেরমুক্তিবাহিনীর তুমুল আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছে লাইটনিং।
দেশতো মনে হয় স্বাধীন হয়ে যাচ্ছেরে বেটা। আবারো আদরের হাত বুলান তিনি পলাশের গায়ে। স্বাধীন হবার পরে তুই আর তোর বোন ইতিহাস হয়ে যাবিরে। বাংলাদেশের প্রথম সন্তান তোরা। যেই-তেই সন্তান না তোরা, যোদ্ধা সন্তান।
যেন সব বুঝতে পেরেছে এমন ভঙিতে বো উঁচু করে বুক ফুলায় পলাশ। গতি বাড়িয়ে সম্মুখে ধাবমান পদ্মার কাছে যাবার চেষ্টা করে সে।
রুহুল আমিন নিঃশব্দে হাসেন। সন্তান গর্বে গর্বিত পিতার হাসি। 
৪. 
ওয়ারলেসের উপর প্রায় ঝুঁকে এসেছেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জয়ন্ত রায় চৌধুরী। প্রবল উত্তেজনার কারণে এটা হয়েছে, কেননা অন্যপাশের কথা তিনি পরিষ্কারই শুনতে পাচ্ছেন। পলাশের কমান্ডার ইন চীফ তিনি। উত্তেজনায় কপালে শুধু ভাঁজই পড়ে নি তাঁর, এই শীতের দুপুরে ঘামও জমা হচ্ছে সেখানে। গভীর মনোযোগ দিয়ে কথা বলছেন তিনি পানভেলে থাকা কমান্ডার সামন্তের সঙ্গে। কথা বলছেন আর ক্ষণে ক্ষণে তাকাচ্ছেন উত্তর আকাশের দিকে। রূপসা ঘাটের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে পলাশ।
আমরা আনআইডেন্টিফায়েড তিনটা ফাইটার প্লেন লোকেট করেছি স্যার। উত্তর দিক থেকে আমাদের দিকেই আসছে। পদ্মা থেকেও একই মেসেজ এসেছে। গানারদের রেডি হতে বলবো কি?
আমরাও লোকেট করেছি ওগুলোকে। তোমার লোকদের প্রস্তুত থাকতে বলো। আমি দেখছি এদের পরিচয় পাওয়া যায় কি না? শান্ত স্বরে কমান্ডার মানবেন্দ্র সামন্ত বলেন।  পোড় খাওয়া নাবিক তিনি।
চিৎকার করে সবাইকে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত হতে বললেন কমান্ডার চৌধুরীযুদ্ধ বিমানের উপস্থিতির খবর এর মধ্যেই জানাজানি হয়ে গিয়েছে। সমস্ত গানবোট জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে উত্তেজনা। দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু হয়ে গিয়েছে চারপাশে। এরা সবাই প্রশিক্ষিত নাবিক। পাকিস্তান নৌবাহিনী থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। কী করতে হবে এই পরিস্থিতে, তা খুব ভালো করেই জানে এরা।
ওয়ারলেস সেটটা ঘড়ঘড় করে উঠতেই আবারো ঝুঁকে পড়েন জয়ন্ত রায় চৌধুরী। ওপাশ থেকে শোনা যায় কমান্ডার সামন্তের গলা।
রয়, আই চেকড উইথ ইস্টার্ন কমান্ড। দৌজ এয়ারক্রাফটস আর আওয়ারস এয়ারক্রাফটস। কামিং ফ্রম ওয়েস্ট দিনাজপুর এয়ারফিল্ড। খুলনা বম্বিং জোনের মধ্যে। ওখানেই মনে হয় বম্বিং করতে এসেছে। নাথিং টু বি এফরেইড।
কিন্তু স্যার, ওরা যদি আমাদেরকে পাকিস্তানি ভেবে আক্রমণ করে?
করবে না। আমাদের সবগুলো জাহাজের সুপারস্ট্রাকচার হলুদ রঙে করা হয়েছে একারণে। ওরা হলুদ দেখেই বুঝবে এগুলো মিত্রবাহিনীর জাহাজ। টেল ইওর সেইলরস টু রিলাক্স।
কাঁচের জানালা দিকে আকাশ পানে তাকান লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। খালি চোখেই এখন বিমানগুলোকে দেখা যাচ্ছে। উচ্চতা অনেক কমে এসেছে। জাহাজের সাথে একই লাইনে আছে দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, জাহাজগুলোর দিকেই এগিয়ে আসছে সরাসরি। ভ্রু দুটো কুঁচকে যায় তাঁর। কিছু একটা জিনিস মাথার মধ্যে খচখচ করছে। অশুভ কু ডাক শুনতে পাচ্ছেন তিনি মনের মাঝে।
মাথা ঝাঁকিয়ে কুচিন্তাটাকে দূর করেন তিনি। কেশে গলা পরিষ্কার করেন। তারপর বলেন, স্যার, বলাতো যায় না। যুদ্ধ চলছে। ভুল করে যদি আমাদেরই আক্রমণ করে বসে। কি করবো আমরা? আত্মরক্ষা কি করা যাবে? আমাদের কাছেতো এন্টি এয়ারক্রাফট বোফর কামান আছে।
দীর্ঘ একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে। ওপাশে কমান্ডার সামন্ত কী করছেন, সেটা অনুমান করার চেষ্টা করেন জয়ন্ত রায় চৌধুরী। জানালা দিয়ে আবারও আকাশপানে তাকান। সগর্জনে উড়ে আসছে শিকারী ঈগলের দল, একটা নিখুঁত জ্যামিতিক ত্রিভুজ তৈরি করে।
লিসেন রয়। কমান্ডারের গম্ভীর গলা ভেসে আসে। ওগুলো আমাদের এয়ারক্রাফট। কোনো অবস্থাতেই এদের দিকে গুলি ছোড়া যাবে না। এত বড় ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়তুমি আর আমি, দুজনেই ভারতীয়। পরিণতি কী হবে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো? আমাদের দুজনের কোর্ট মার্শাল কেউ ঠেকাতে পারবে না। তোমাকেই নিশ্চিত করতে হবে, অন্যেরা যেনো কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেয়। আমরা যুদ্ধ করছি পেশার কারণে, ওরা যুদ্ধ করছে আবেগের কারণে। হঠকারী আচরণ ওরা করতে পারে, আমরা না। গো এন্ড ডিজআর্ম দেম। আমি পদ্মাকেও একই নির্দেশ দিয়েছি।
ফরোয়ার্ড ডেকে চলে আসেন রায় চৌধুরী। সবাই তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। বয়েজ, ওগুলো ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের প্লেন। খুলনায় বোমা ফেলতে এসেছে। আমাদের ভয়ের কিছু নেই। কোনো গুলিটুলি করা যাবে না ওদেরকে নিশানা করে। গো এন্ড রিল্যাক্স।
লেফটেন্যান্ট কমান্ডারের কথা শুনে ঢিল পড়ে সবার শরীরে। 
৫. 
মচমচ করে বিকট শব্দ হচ্ছে চৌকিতে। যেন ভেঙেই যাবে ওটা প্রচণ্ড চাপেনগ্ন কোমরটাকে তীব্রভাবে ওঠানামা করছে দেলু রাজাকার। লোমশ ভালুকের মত বিশাল শরীর তার। হঠাৎ করে পিছন থেকে দেখলে যে কেউ ভাববে যে, একা একাই চৌকির উপর কোমর দোলাচ্ছে সে। বাচ্চা মেয়েটার ছোট শরীরটা প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে দেলু রাজাকারের বিশাল শরীরের নীচে। শুরুতে মরণ চিৎকার দেওয়া শুরু করেছিল মেয়েটা। মুখ চেপে ধরে আর্তনাদকে ঠেকানোর কোনো চেষ্টাই করে নি দেলু রাজাকার। বাইরে তাঁর সাঙাৎরা পাহারা দিচ্ছে বন্দুক হাতে। কারো বাপের সাধ্যি নেই ত্রিসীমানায় আসার। তারা এসেছিল মূলত লুট করতে। লুট করতে গিয়ে অবশ্য খুনোখুনিও করতে হয়েছে। তাতে অবশ্য আনন্দই পেয়েছে সে, ঝামেলা মনে হয় নিহিন্দুদের কল্লা কাটতে বেশ ভালোই লাগে তার। কেমন যেন জেহাদি জেহাদি একটা জোশ জাগে মনে। নিজেকে খালিদ বিন ওয়ালিদের মতো বিরাট ইসলামি যোদ্ধা মনে হয়। তবে, খুন করার চেয়েও হাজার গুণে বেশি আনন্দ লাগে মালাউন মেয়েগুলোর সাথে ওইসব কাজ করতে। এগুলোর পেটে বীজ বপনের আনন্দের কোনো তুলনাই হয় না।
খুন খারাবির পর সোনাদানা-টাকা পয়সা লুট করতে ঘরের ভিতরে ঢুকেছিল তারা। জানের ভয়ে চৌকির নীচে লুকিয়ে ছিল ভয়ার্ত মেয়েটা। এগারো বারো বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে। ভাবলেও হাসি পায় দেলুর। এটা কোনো লুকোনোর জায়গা হলো? চৌকির নীচ থেকে চুল ধরে টেনে বের করা হয়েছে মেয়েটাকে। সেকি চিৎকার মেয়েটার। যেন কেউ তাকে ধরে কোরবানি দিচ্ছে। সাঙাৎদের ইশারা করেছে সে ঘর থেকে বের হয়ে যাবার জন্য। লোভী হাসি হেসে তারা বের হয়ে গিয়েছে। দেলু ওস্তাদের পরে তাদেরও আশ মিটবে, জানে তারা।
বয়স বাড়ার পর থেকেই কচি মেয়েদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে দেলু। তার তৃতীয় বিবির বয়স মাত্র ছাব্বিশ বছর। তারপরেও সেটাকে বুড়ি বলে মনে হয় তার কাছে। চতুর্থ বিয়েটা করেই ফেলতো সে। কিন্তু দেশের এই দুর্যোগের সময়, ইসলামের এই দূরাবস্থায় ব্যক্তিগত খায়েশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। একজন সাচ্চা জেহাদি ইসলামি সৈনিক যদি তার মনের কামনা-বাসনার উপর নিয়ন্ত্রণ নিতেই না পারে, তাহলে আর সে ইসলামের সৈনিক হলো কীভাবে? এই ভেবেই নিজের মনকে প্রবোধ দিয়ে চলেছে সে। অবশ্য মন বশ মানলেও, শরীর মানতে চায় না। কচি কাচা মেয়ে দেখলেই, শরীরের শিরায় শিরায় শ্রাবণের বান ডাকে।
সাঙাৎরা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই দুয়ারে খিল দেয় দেলু। ভয়ে আতংকে নীল হয়ে যাওয়া মেয়েটার সামনেই পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি খুলে ফেলেবিস্ফারিত চোখে মেয়েটা তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এরকম কোনো কিছুর অভিজ্ঞতা নেই তার এই স্বল্প বয়সে। ওই অবস্থাতেই ধাক্কা দিয়ে চৌকির উপরে শুইয়ে দেয় দেলু তাকেবিশাল একটা গ্রিজলি ভালুকের মতো শরীরটাকে তুলে আনে বাচ্চা মেয়েটার ছোট্ট শরীরের উপরে। শুরুতে অমানুষিক চিৎকার করেছে মেয়েটা ব্যথায়, ভয়েদেলু সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই করে নি। এই চিৎকারে তার উত্তেজনা আরো বেড়েছে। চিৎকার একসময় গোঙানিতে রূপ নিয়েছে। তারপর নিস্তব্ধ নৈঃশব্দ। নিথর হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটি। মরে গেছে, না অজ্ঞান হয়েছে বোঝার উপায় নেই। এ নিয়ে অবশ্য মাথা ব্যথা নেই দেলুর। কাজ শেষ হলে এমনিতেও তো মারতেই হবে মেয়েটাকেনিজের কাজ করে যাচ্ছে সে বিপুল বিক্রমে।
দরজায় জোরে জোরে আঘাতের শব্দে হুশ ফেরে দেলুর। কোমর দোলানো বন্ধ করে চরম বিরক্তি নিয়ে বলে, এই কি হোইচ রে, মুক্তিফোর্জ এ্যইছ নাই, নাকি কি তোদের আর সহ্যো হচ্ছে না?
কালু মোল্লার অস্থির গলা শুনতে পাওয়া যায়। দেলু ভাই, শিগগিরি বাইরি আসেন। কালুর গলায় এমন একটা তাগাদা ছিল যা উপেক্ষা করতে পারে না দেলু। মেয়েটার উপর থেকে উঠে পড়ে সে। বিছানা একেবারে রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। তার নিজেরও দুই উরুর সংযোগস্থলেও বিপুল পরিমাণে রক্ত লেগে রয়েছে। আশ্চর্য রকমের একটা প্রশান্তিতে মনটা ভরে যায় তার। রক্ত না মুছেই লুঙ্গিটা পরে নেয় সে। গায়ে পাঞ্জাবি গলাতে গলাতে দরজা খোলে সে।
দরজার সামনেই উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার চার সাঙাৎভয়ের একটা শীতল স্রোত নেমে যায় দেলুর শিরদাঁড়া বেয়ে। কী হোলু? এরাম মড়ার মোতোন চেহারা ক্যান, সবার?
পেলেন। হাত তুলে উত্তর আকাশের দিকে দেখায় কালু।
কালুর বাড়ানো হাতকে অনুসরণ করে দেখার আগেই শব্দ কানে আসে তার। ঘরের মধ্যে উত্তেজিত অবস্থায় ছিল বলেই বোধ হয় শব্দ কানে যায় নি। এখন কান ফাটানো শব্দ আসছে। তিনটা যুদ্ধ বিমান ডাইভ দিয়েছে একই সাথে। দ্রুতগতিতে নেমে আসছে ভূমির দিকে।
এ কাদের পেলেন রে? পাকিস্তানের না ইন্ডিয়ার? চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে সে।
জ্যান নে। কেউ একজন অনিশ্চিত স্বরে উত্তর করে।
প্লেনগুলো কোথায় আক্রমণ শানাতে যাচ্ছে, তা হঠাৎ করেই বুঝে ফেলে দেলু রাজাকার। নদীর দিকি চল দিন সবাই। ঠিক জাহাজের ওপরেই বোমা ফ্যালবে পেলেনগুলু।
কারো উত্তরের অপেক্ষায় না থেকেই নদীর দিকে ছুট লাগায় দেলু রাজাকার। তার সাঙাৎরা বেয়োনেট লাগানো বন্দুক কাঁধে নিয়ে ছুটতে থাকে তার পিছনে।
এক পাল হায়েনা ছুটে চলেছে রূপসার দিকে। 
৬. 
ওরা আমাদের আক্রমণ করতে যাচ্ছে। কেউ একজন আতংকিত গলায় চেঁচিয়ে ওঠে।
প্রবল বিস্ময়ে ঘাড় ঘুরিয়ে জয়ন্ত রায় চৌধুরী তাকান আকাশে দিকে। কমান্ডার সামন্তের কথা শুনে তিনিও নিশ্চিন্তে ছিলেন। এখন মনে হচ্ছে অতটা নিশ্চিত না হলেই বোধ হয় ভালো হতো। শিকার ধরার সময় বাজপাখি যেমন অনেক উঁচু থেকে ভয়ংকর গতিতে নেমে আসে, ন্যাট বিমান তিনটি ঠিক সেভাবেই নেমে আসছে তাদের দিকে। ভাবভঙ্গিতে আক্রমণের চিহ্ন পরিষ্কার। জয়ন্ত রায়ের অভিজ্ঞ চোখ এই চিহ্ন পড়তে ভুল করে না একদমই
শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো সবাই। চিৎকার করে আদেশ দেন তিনি। নিজেও লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েন ডেকের উপরে।
বিমান তিনটা সোজা নেমে আসে পদ্মার উপরে, সগর্জনেদেখে মনে হয় যেন পদ্মার সাথে সরাসরি সংঘর্ষ ঘটতে যাচ্ছে। পদ্মার ঠিক সামান্য উপরে এসে নাক উঁচু করে বিমানগুলো। আর ঠিক সেই মুহুর্তেই বোমাগুলো বের হয়ে আসে তাদের পেটের নীচ থেকে। বোমা ফেলেই পলাশের উপর দিয়ে উড়ে চলে যায় দক্ষিণে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেপে ওঠে পদ্মার ইঞ্জিন রুম। কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় আকাশ। ন্যাট বিমানগুলো নাক উঁচু করে হারিয়ে যেতে থাকে দক্ষিণের দিগন্তেপদ্মায় আক্রমণ করে পলাশের মাস্তলের এতো কাছ দিয়ে উড়ে গিয়েছিল সেগুলো যে, পেটে আঁকা অশোক চক্র শোভিত তিন রঙা পতাকাটা দেখতে একটুও ভুল হয় নি জয়ন্ত রায় চৌধুরীর।
সবাই ছুটে যায় ফরোয়ার্ড ডেকের রেলিং এর দিকে। আগুনের তাপ থেকে নিজেকে বাঁচাতেই যেন রূপসার রূপালি জলে ডুবে দিচ্ছে পদ্মা। হইচই চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে চারিদিক থেকেনৌ সেনারা প্রাণ বাঁচাতে ঝাপিয়ে পড়ছে ঠাণ্ডা পানিতে।
ঠিক সেই মুহুর্তে দূরবর্তী ইঞ্জিনের মৃদু আওয়াজ কানে ভেসে আসে জয়ন্ত রায় চৌধুরীর। দক্ষিণ আকাশের দিকে তাকান তিনি। সাদাটে রঙের হালকা মেঘের ভাঁজে তিনটি কালো বিন্দু আবিষ্কার করেন তিনি।। ফিরে আসছে বিমানগুলো। নিশ্চিতভাবেই হামলা চালানোর জন্য আবার। দিগন্ত সীমার ওপারে চলে গিয়েছিল তারা পদ্মায় আক্রমণ শাণিয়ে। ওখান থেকে অর্ধ্ববৃত্তাকারে ঘুরে, ফিরে আসছে নতুন আক্রমণের উদ্দেশ্যে। এবার নিশ্চয়ই পলাশ তাদের লক্ষ্য।
উই আর গোয়িং টু ইভাকুয়েট পলাশ। হারি আপ এভরিবডি। হুকুম দিলেন তিনি। 
৭. 
হাঁফাতে হাঁফাতে ইঞ্জিনরুমে আসে মোশাররফ। তরুণ একজন নৌসেনা সেকমান্ডার স্যার আদেশ দিয়েছেন। আমরা পলাশ ছেড়ে যাচ্ছি। প্লেনগুলো আবার আসছে এটাক করতে।
প্রবল ব্যস্ততায় নিজের কাজ করে যাচ্ছিলেন রুহুল আমিন। বিস্মিত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন তিনি তরুণের দিকে। পলাশ ছেড়ে যাচ্ছি আমরা?
জ্বি স্যার। হাতে সময় নেই। পদ্মা ধ্বংস হয়ে গেছে। এইবার আমাদের পালা। আপনারা তাড়াতাড়ি করেন।
মাথার মধ্যে আগুন ধরে যায় রুহুল আমিনের। উঠে দাঁড়ান তিনি। মোশারফফকে এক হাতে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে দুড়দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে আসেন তিনি। ডুবন্ত পদ্মার দিকে চোখ যায় তাঁর। সন্তান হারানোর তীব্র বেদনা এসে পাঁজরে বিদ্ধ হয় তাঁর। এক মুহুর্তের জন্য স্থবির হয়ে যান তিনি প্রবল যন্ত্রণায়পদ্মার গায়ের জ্বলন্ত আগুন দেখতে দেখতে টের পান তাঁর মাথার মধ্যের আগুনও দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরেখপ করে পাশে দাঁড়ানো রউফের বুকের কাছের শার্ট চেপে ধরেন তিনি। পলাশের একজন গানার সে। টেনে নিয়ে আসেন নিজের কাছাকাছি।
পদ্মায় বোমা পড়লো কীভাবে? কামানের পিছনে বসে ঘোড়ার ঘাস কেটেছো তোমরা? প্লেনগুলোকে ফেলতে পারো নি? প্রবল রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে তিনি বলেন।
রুহুল আমিনের বজ্রমুষ্ঠিতে চাপা পড়ে হাঁসফাঁস করে রউফ। ভয় পেয়েছে সে খুবরুহুল আমিনের বদমেজাজের কথা কারোরই অজানা নয়।
আমরাতো কামান দাগি নাই স্যার। তোতলাতে তোতলাতে বলে সে।
কামান দাগো নাই? বিস্ময় যেন বাধ মানে না রুহুল আমিনের। কেনো? গর্জে ওঠেন তিনি।
আমি নিষেধ করেছি। পিছন থেকে গম্ভীর একটা কণ্ঠ ভেসে আসে। ওগুলো ইন্ডিয়ার প্লেন।
রউফকে ছেড়ে দেন রুহুল আমিন। চরকির মতো ঘুরে যান তিনি। চোখে তীব্র আগুন নিয়ে তাকান জয়ন্ত রায় চৌধুরীর দিকে। যেন ভস্ম করে ফেলবেন তাঁকে।
পলাশ ছেড়ে যাবার আদেশ কেনো দিয়েছেন আপনি?
বললাম না। ওগুলো ইন্ডিয়ার প্লেন। আবারো আসছে আমাদের এটাক করতে। ইভাকুয়েট ছাড়া আর কী উপায় আছে বলো?
এটা যুদ্ধ জাহাজ। আমাদের এন্টি এয়ারক্রাফট গান আছে। যুদ্ধ না করে চোরের মতো পালাবো কেনো আমরা?
রুহুল, তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছো? বলছি না ওগুলো ইন্ডিয়ার প্লেন। তুমি ইন্ডিয়ার প্লেনে কামান দাগতে চাও?
অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে জয়ন্ত রায় চৌধুরী দিকে এগিয়ে যায় রুহুল আমিন। প্রথম দেখায় মনে হবে যেন গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছে। জয়ন্ত চৌধুরীর খুব কাছে গিয়ে হুংকার ছাড়ে রুহুল।
এটা বাংলাদেশের যুদ্ধ জাহাজ। একে যে আক্রমণ করতে আসবে তার দিকেই কামান দাগাবো আমরাইন্ডিয়া পাকিস্তান বুঝি না। জাহাজ ছেড়ে কেউ যাচ্ছি না আমরা। আপনি সবাইকে বলেন এ কথা।
আগুন জ্বলে ওঠে জয়ন্ত রায় চৌধুরীর চোখেওতীব্র দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে থাকেন রুহুল আমিনের দিকে। রাগে কাপছে তাঁর সমস্ত শরীর।
আমি এই গানবোটের কমান্ডিং অফিসার। হু দ্য হেল আর ইউ টু টেল মি হোয়াট টু ডু? আমরা ইভাকুয়েট করছি। এটাই ফাইনাল। এক চোখে আগুয়ান বিমানগুলোর দিকে তাকান তিনি। খুব কাছে চলে এসেছে ওগুলো।
অনল দৃষ্টিতে জয়ন্ত রায় চৌধুরীর দিকে অনন্তকাল তাকিয়ে থাকেন রুহুল আমিন। আফ্রিকার জঙ্গলে যুদ্ধমান দুই সিংহ যেন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মরণ লড়াই শুরু হবার ক্ষণে।
প্রথমে সামলে নেন রুহুল আমিনই। দুই পা পিছিয়ে যান তিনিপিছন ফিরে তাকানসবার দৃষ্টি তাঁদের দিকে। ধমকে ওঠেন তিনি।
মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো সবাই? যে যার পজিশনে যাও। পলাশ ছেড়ে আমরা কেউ যাচ্ছি না। প্লেনগুলোকে উড়িয়ে দেব আমরা।
তুমি উর্ধ্বতন অফিসারের কমান্ড অমান্য করছো রুহুল। কোর্ট মার্শালের ব্যবস্থা করবো আমি যুদ্ধের পরে তোমারতোমার মৃত্যুদণ্ড কেউ ঠেকাতে পারবে না। শুধু তুমি না, অন্য যারা আমার কমান্ড অমান্য করবে সবারই ফাঁসির ব্যবস্থা করবো আমি। পিছন থেকে কঠিন গলায় জয়ন্ত বলেন।
জয়ন্তর দিকে ঘুরে দাঁড়ান রুহুল আমিন। ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসি। আশ্চর্য রকমের শান্ত স্বরে বলেন,
চট্টগ্রাম নৌঘাটি থেকে পালিয়ে যেদিন ত্রিপুরাতে গিয়েছি স্যার, সেদিন থেকেই জীবনটা দেশের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছি আমিখামোখা আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই স্যার
ঘাড় ঘুরিয়ে দক্ষিণ আকাশের দিকে তাকন তিনি। মৃত্যুদূতের মতো এগিয়ে আসছে যুদ্ধ বিমান তিনটা। অস্থির চঞ্চল হয়ে ওঠেন তিনি
কুইক, যে যার পজিশনে যাও। সময় নেই। তাড়া দেন তিনি। নিজেও ছুটতে থাকেন সিঁড়ির দিকে। ইঞ্জিন রুমে যেতে হবে তাকে দ্রুত।
রুহুল আমিনের ছুটন্ত একহারা শরীরের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন জয়ন্ত। বুকের মধ্যে ঈর্ষা মিশ্রিত আশ্চর্য এক ধরণের ভালবাসা অনুভব করছেন তিনি এই রগচটা লোকটার জন্য। দেশের জন্য যাদের বুকের মধ্যে এরকম অফুরন্ত ভালবাসা জমানো, সেই বাঙালদের পরাধীন করে রাখার শক্তি পৃথিবীর কারোরই নেই। 
৮. 
ন্যাট বিমানগুলো হামলা চালালো প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত গতিতে। পলাশে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল তার পুরো ফায়দা নিয়ে। চিলের মতো ছো মেরে সেগুলো নেমে এলো পলাশের ঘাড়ের উপরে। একেবারে নিঃশ্বাস ফেলার দুরত্ব থেকে কোনোরকম প্রতিরোধ ছাড়াই পলাশের গায়ে বোমা ফেললো তারা।
একটা বোমা এসে পড়লো ইঞ্জিন রুমে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ শব্দে কানে তালা লেগে গেলো রুহুল আমিনের। বিস্ফোরণের ধাক্কায় দেয়ালে গিয়ে পড়েছে তাঁর শরীরটা। তীব্র ব্যথায় আবিষ্কার করলেন যে, একটা হাত উড়ে গিয়েছে বোমার আঘাতে। জাহাজে রাখা গোলাবারুদগুলো ফুটছে। কোনো রকমে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে এলেন তিনি বাইরে। টেনে হিঁচড়ে শরীরটাকে নিয়ে উঠে এসেছেন ডেকে। চারিদিকে মৃত্যুর ছড়াছড়ি। যারা জীবিত আছে ছুটোছুটি করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। শরীরের ভারসাম্য রাখতে কষ্ট হচ্ছে রুহুল আমিনের। একদিকে হেলে পড়ছে আহত পলাশ।
আমার পলাশকে ছেড়ে তোমরা যেও না। ওকে বাঁচাও। ও যে বাংলাদেশের প্রথম সন্তান। এক হাতে রেলিং ধরে দুর্বল স্বরে পলায়নপর নাবিকদের প্রতি আকুতি জানান তিনি।
তুমুল হট্টগোলে তাঁর কথা কানে যায় না কারোরই। আরো কাত হয়ে গিয়েছে পলাশ। শরীরের নীচের অংশে পানি ঢুকছে। সেই চাপে আস্তে আস্তে করে তলিয়ে যেতে থাকে সে। দুর্বল এক হাত দিয়ে রেলিং ধরে কাত হয়ে ছিলেন রুহুল আমি। রক্তে পিচ্ছিল হাত ফসকে যায় রেলিং। উলটে পড়ে যান তিনি রূপসার ঠাণ্ডা পানিতে। পড়েই তলিয়ে যেতে থাকেন তিনি। আবিষ্কার করেন পলাশও তাঁর পাশেই তলিয়ে যাচ্ছে। এক হাত দিয়েই তিনি আঁকড়ে ধরেন পলাশকে। কিছুতেই ডুবতে দেবেন না তাকে তিনিতাঁর নিজের সন্তান তাঁর চোখের সামনেই ডুবে যাচ্ছে, বাবা হয়ে তিনি কীভাবে তা হতে দিতে পারেন? প্রাণপনে তিনি টেনে ধরেন পলাশকে।
পলাশের ভারি শরীরের সাথে তিনিও নেমে যেতে থাকেন অতল জলের গভীরে।
ফুসফুস বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁর সাথে। একটু বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করে ওঠে সেটি। পলাশের গা থেকে হাত ফসকে যায় তাঁর। নিজের অজান্তেই বাতাসের আশায় তাঁর শরীরটা উঠে আসতে থাকে জলের উপরে। পলাশ হারিয়ে যেতে থাকে নিঝুম জলের আঁধারে।
পানির উপরে এসেই বড় করে নিঃশ্বাস নেন তিনি। পলাশের কোনো চিহ্নই নেই কোথাও। হারিয়ে গেছে সে জলের নীচে। সন্তান হারানোর তীব্র বেদনায় আর্তনাদ করে ওঠেন তিনি। পাগলের মতো বার কয়েক পানিতে ডুব দেন তিনি পলাশের খোঁজে।
তোকে বাঁচাতে পারলাম না বাবা। মাফ করে দিস আমাকে। আকুল হয়ে মাঝ নদীতে শিশুর মতো কাঁদতে থাকেন রুক্ষ্ণ কঠিন মানুষটা। 
৯. 
ছোটবেলা থেকেই দক্ষ সাঁতারু তিনি। জল তাঁর আপন ঠিকানা। নদী, নালা, সাগরে তিনি বিচরণ করেন মাছের মত সাবলীলতায়। কিন্তু, সেই তিনিও এখন রূপসার তীরে আসতে রীতিমত সংগ্রাম করছেনআহত অবস্থায় এক হাত দিয়ে সাঁতার কাটাটা দুঃসাধ্যই বটে। প্রবল মনোবলই তাঁকে ভাসিয়ে রেখেছে। জ্ঞান আর অজ্ঞানের একটা মাঝামাঝি অবস্থায় তিনি আছেন। ঠিক যে মুহুর্তে চোখ বন্ধ করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন তিনি, ঠিক সেই সময়ে হাতে মাটির স্পর্শ পেলেন তিনিক্লান্তিতে গা এলিয়ে দিলেন অজান্তেইচোখ খোলারও শক্তি নেই তাঁর। গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
দুটো রোমশ হাত শক্তভাবে চেপে ধরে তাঁর একমাত্র হাতটা। কেউ একজন পানি থেকে টেনে তুলছে তাঁকে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে শুকনো মাটিতে। শুকনো মাটিতে এনে হাতটা ছেড়ে দেয় তাঁর। অনেকগুলো উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পান তিনি। কিন্তু কোনো কথাই বুঝতে পারছেন না তিনি। হঠাৎ করেই প্রচণ্ড ব্যথায় কাঁতরে ওঠেন তিনি। কেউ একজন তাঁর কাটা হাতের জায়গাটাতে ভুল করে পা চেপে ধরেছে। এই ব্যথাতেই সচেতন হয়ে ওঠেন তিনি। ভারি চোখ মেলে তাকান। একজন দাঁড়িওয়ালা লোক তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। বিশাল ভালুকের মত চেহারা। পাশে আরো চারজন। সবার হাতেই বেয়োনেট লাগানো বন্দুক। কারা এরা? স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা?
তাঁর উড়ে যাওয়া হাতের ক্ষতস্থানে পায়ের চাপ আরো বাড়ে। ব্যথায় মুচড়ে ওঠে শরীরটা তাঁরএরা কেমন লোক? একজন আহত মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। বুঝতে পারছে না, নাকি? লোকটাকে পা সরানোর কথা বলার জন্য তাঁর দিকে তাকান তিনি। ক্রুর একটা হাসি লেগে আছে দেলু রাজাকারের কালো আর মোটা ঠোঁটে। কুতকুতে চোখ দুটো সীমাহীন ঘৃণা আর জিঘাংসা। এরা কারা, সেটা এক মুহুর্তেই পরিষ্কার হয়ে যায় তাঁর কাছে। পালাতে হবে। যেভাবেই হোক পালাতে হবে  এই খুনিদের কাছ থেকে। শরীরটা মুচড়ে ওঠে তাঁর। কাটা হাতে চাপ বাড়ায় প্রতিপক্ষ।
চার বন্দুকধারী রাজাকার বন্দুক উলটো করে ধরে কাঁধের একপাশে তোলে। দুপুরের রোদ বেয়োনেটগুলোতে প্রতিফলিত হয়ে তাঁর চোখ ঝলসে দেয়। অসহায় আত্মসমর্পণে চোখ বন্ধ করেন তিনি
কোঁচ যেভাবে মাছকে বিদ্ধ করে, ঠিক সেইভাবে তাঁর আহত শরীরটাকে বিদ্ধ করার জন্য চারটে নিষ্ঠুর বেয়োনেট নেমে আসতে থাকে সবেগে।

আমরা ইতিহাস অসচেতন জাতি। কোনো ঘটনা লিখে যাওয়ার প্রতি আমাদের অনীহা রয়েছে। পলাশ এবং পদ্মার ঘটনা খুঁজতে গিয়ে কোথাও বিস্তারিত কিছুই পাই নি আমি। সবই কেমন যেন ভাসাভাসা গৎবাঁধা বিবরণ। পলাশে ইঞ্জিন রুম আর্টিফিসার হিসাবে কাজ করেছেন রুহুল আমিন। পলাশ ধ্বংস হবার আগে নাটকীয় এক এনকাউন্টারে গেছেন তিনি এর কমান্ডিং অফিসারের সাথে। সেই সব বিবরণ বিস্তারিত কেউ লিখে যায় নি। তাঁর সঙ্গীদেরতো এগুলো জানার কথা। অবশ্য এগুলোর কথা আর কী বলবো। ফোর্স আলফার অপারেশনেরও পুরো ঘটনা কোথাও নেই। আমি অনেক খুঁজে একটা বই পেয়েছিনাম Transition to Triumph: History of Indian Navy, 1965-75. এই বইতে কমান্ডার মানবেন্দ্র সামন্তের বরাত দিয়ে ফোর্স আলফার অপারেশনের কথা লেখা আছে। তবে, পলাশের অভ্যন্তরীন ঘটনা সেখানে অনুপস্থিত বোধগম্য কারণেই। কমান্ডার সামন্ত পলাশে ছিলেন না, ছিলেন পানভেলে।

Thursday, November 26, 2015

প্রীতি

২০০৫ সাল।

রাজশাহী শিশু একাডেমীতে মন্ত্রী আসবেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী। প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার দেওয়া হবে। সেটারই প্রধান অতিথি তিনি। মন্ত্রীকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানানো হবে। মঞ্চের পাশেই সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর এক বাচ্চা মেয়ে। সবেমাত্র ক্লাস থ্রিতে পড়ে। খুবই সপ্রতিভ, দুর্দান্ত সাহসী এবং দারুণ চটপটে সে। যে কোনো মন্ত্রী, সাংসদ বা বিদেশী অতিথি এলে, ফুলের তোড়া উপহার দেবার জন্য সবসময়ই ডাক পড়ে তার। এই ভূমিকা আগে অসংখ্যবার করেছে বলে তেমন কোনো বিকার নেই তার মধ্যে।
হঠাৎ করে লোকজনের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। মন্ত্রী এসে গেছেন। বাচ্চা মেয়েটাও সামান্য নড়েচড়ে প্রস্তুত হয়। তার কাজ শুরু হবে এখনই যে।

মাইকে ভেসে আসে উপস্থাপকের কণ্ঠ। সম্মানিত সুধী, আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী মান্যবর আলী আহসান মুজাহিদ। তাঁকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগতম জানাবে ছোট্ট মণি প্রীতি।

ঘোষণা কানে যেতেই বাচ্চা মেয়েটা স্থির হয়ে যায়। পাশে দাঁড়ানো শিশু একাডেমীর পরিচালক সুখেন মুখার্জী আস্তে করে তাকে বলেন, 'যাও।'

যেনো কোনো কথা শোনে নি এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সে। সুখেন মুখার্জী এবার তাড়া দেন, 'কই যাচ্ছো না কেনো?'

মন্ত্রী এসেছেন। এতো বড় একটা অনুষ্ঠান। গভীর উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন তিনি।

'এই রাজাকারটাকে ফুল দেবো না আমি।' কঠোর স্বরে বলে প্রীতি।

বাচ্চা মেয়েটার কথা শুনে চোয়াল হা হয়ে যায় সুখেন মুখার্জীর। প্রীতির কথাটা ঠিকমতো শুনেছেন কিনা, সেটা নিয়েই নিজের মধ্যে সন্দেহ জাগে তাঁর। প্রবল বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেন, 'কী বললে?'

'এই রাজাকারটাকে ফুল দেবো না আমি।' টেনে টেনে কঠিন গলায় বলে প্রীতি।

পড়তে শেখার পর থেকেই বইয়ের পোকা সে। রাজাকার কী, সেটা খুব ভালো ভাবেই জানে। মুজাহিদ কী ছিলো একাত্তরে, সেটাও খুব ভালো করে জানা আছে তার।

প্রীতিকে বোঝানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালান সুখেন মুখার্জী। কোনো কাজ হয় না তাতে। একরোখা ভঙ্গিতে ঘাড় গোঁজ করে অনড় দাঁড়িয়ে থাকে সে।

প্রীতিকে পটাতে ব্যর্থ হয়ে সুখেন মুখার্জী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যান অন্য কোনো বাচ্চার খোঁজে। এই একগুঁয়ে এবং অমিত তেজি মেয়েটা যে মন্ত্রীকে ফুল দেবে না, সেটা তিনি তার ভাব দেখেই বুঝে গিয়েছেন। তিনি নিজেও এই রাজাকারটাকে দুই চোখে দেখতে পারেন না। ফুল দিয়ে একে স্বাগত জানাতে না হলে, নিজেই সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। কিন্তু, কিছু করার নেই। চাকরি তো বাঁচাতে হবে। বউ, বাচ্চা আছে তাঁর। চাকরিটা গেলে যে, না খেয়ে মরতে হবে।

সুখেন মুখার্জী চোখের আড়াল হতেই, খুঁজে পাওয়া যাবে না, এমন এক জায়গায় ফুলের তোড়াটাকে লুকিয়ে ফেলে প্রীতি তড়িৎ গতিতে।


ফুলের মালা নয়, গলায় ফাঁসির দড়ি প্রাপ্য এই সব রাজাকারদের।

শেখের বেটি

আজকে বাংলাদেশে রাজাকার-আলবদরদের বিচার হচ্ছে। সবাই খুশি আমরা। কুখ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লা, কামরুজ্জামান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসি হয়ে গেছে। গোলাম আযম, দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর জেলদণ্ড হয়েছে। মতিউর রহমান নিজামীর রায়ও খুব শীঘ্রই হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

স্বাধীনতার এতো বছর পরে এসে এই সব রাজাকারদের বিচার করাটা একটু কঠিন ব্যাপারই। সেটা আরো দুঃসাধ্য হয়েছে অন্য একটি কারণের জন্যও। স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথাতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলো একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা। তারপর থেকে আমাদের সমাজে পুষ্ট হয়েছে তারা। আর্থিক এবং রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করেছে প্রভুত। সমাজেও ভিত গড়ে তুলেছে দারুণ মজবুতভাবে। তাদের দাপট, অহংকার এবং দম্ভে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের সমাজে টিকে থাকাটাই মুশকিল হয়ে পড়েছিলো এক সময়।

এই বাংলার মাটিতে তাদের কৃতকর্মের জন্য বিচার করা যাবে, সেই আশা ছেড়ে দিয়েছিলো প্রায় সকলেই। প্রায় সকলেই, কিন্ত একজন না। সেই একজনের কথাই বলছি।

ইনি একদিন খুব ভোরে হারিয়েছেন তার পরিবারের সদস্যদের। নির্বাসিত জীবন যাপন করেছেন দীর্ঘকাল। তারপর ফিরে এসেছেন দেশে। আন্দোলন, সংগ্রাম করেছেন গণতন্ত্রের জন্য। তাঁর জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে তারেক আর বাবরের গুণ্ডাবাহিনী। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তিনি। হারিয়েছেন এক কানের শ্রবণ ক্ষমতা চিরতরে। ছদ্ম সেনা শাসকেরা তাঁকে দেশে আসতে দিতে চায় নি কেয়ারটেকার সরকারের সময়। খালেদা জিয়াকেও দেশ থেকে বের করে দীর্ঘস্থায়ী সেনা শাসন কায়েমের পরিকল্পনা ছিলো তাদের। তিনি জানতেন দেশে ফিরলে গ্রেফতার হবেন, তারপরেও ফিরে এসেছিলেন অসীম সাহসিকতা নিয়ে। তিনি আসাতে খালেদা জিয়াও শক্তি পান, নির্বাসনে যাবেন না বলে পণ করেন তিনিও। ছদ্ম সেনা শাসকেরা দুজনকে জেলের মধ্যে পুরে দেয়। দুজনের মাটি কামড়ে দেশে পড়ে থাকার কারণে বাংলাদেশ বেঁচে যায় আরেক সেনা শাসনের হাত থেকে।

তাঁর বাচালতার কারণে তিনি প্রায়শই সমালোচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি তাঁকে ছাড় দেয় না এক বিন্দুও। পারলে দুনিয়া থেকেই বিদায় করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিরও কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হন তিনি প্রায়শই। নিঃসঙ্গ একজন মানুষ তিনি। তাঁর যতোখানি প্রাপ্য ছিলো প্রশংসার, সেটা পান নি তিনি। বরং তাঁর কিছু কাজের জন্য নিন্দাটাই বেশি জুটেছে কপালে তাঁর।

তারপরেও এইটুকু বলতে আজ দ্বিধা নেই যে, তিনি না থাকলে এই সব রাজাকারদের বিচার করার ক্ষমতা বাংলাদেশে আর কারো ছিলো না। এটা করতে গিয়ে তিনি নিজের জীবনের উপরেও ঝুঁকি নিয়েছেন। চিরদিন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন না। একবার ক্ষমতা থেকে সরে গেলেই এই সব শকুন, কুকুরেরা ছিড়ে ফুড়ে খাবে তাঁকে প্রবল প্রতিহিংসায়।

অনেকেই অনেক নামে ডাকেন তাঁকে। কেউ ডাকে আপা, কেউ ডাকে বুবু, কেউ ডাকে জননেত্রী বলে। সব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি আসলে শেখের বেটি। শার্দুলের বাচ্চা যে শার্দুলই হয়, সেটা প্রমাণ করেছেন এই শেখের বেটি।

সশ্রদ্ধ সালাম আপনাকে শেখের বেটি।




Tuesday, November 24, 2015

আধুনিক চিন্তাধারায় ডারউইনের প্রভাব

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পরিবেশের সাথে বিভিন্ন প্রজাতির অভিযোজনের ধারণাকে পূর্ণাঙ্গ বিবর্তন তত্ত্ব হিসাবে রূপ দেনডারউইন। সেই তত্ত্বে প্রাকৃতিক নির্বাচনকে গুরুত্ব দেওয়া হয় প্রাকৃতিক নির্বাচনে অধিকতর সুবিধাজনক গুণগুলো বংশাণুক্রমে ছড়িয়ে যেতে থাকে পরবর্তী বংশধরসমূহের মধ্যে। ডারউইনের তত্ত্বকে জন্মের পরে শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক নীরিক্ষার মধ্য দিয়েই যেতে হয়নি, ধর্মীয় সমালোচনাকেও সইতে হয়েছে তীব্রভাবে।  তবে সেই তত্ত্ব ছিল দীর্ঘ পথের সুত্রপাত মাত্র। বিবর্তনবাদবাদ তত্ত্বের ফলশ্রুতিতে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য গবেষণা প্রশ্নের যা আজকের যুগের বিজ্ঞানীদেরকেও অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

বিবর্তনের ধারণা কিন্তু অনেক সুপ্রাচীন। এমনকি সক্রেটিসের আগেও কীভাবে যোগ্যতম টিকে থাকে সে বিষয়ে চিন্তা করা হয়েছে। অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দী জীবন কীভাবে উদ্ভব হয়েছে সে সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

ডারউইনের বিবর্তনবাদই প্রথম ঊনবিংশ শতাব্দী এবং তার পরেও বৈজ্ঞানিক শক্তপক্ত পরীক্ষাতেও টিকে গেছে। আজকের যুগে বিজ্ঞানীরা উন্নতমানের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, ক্যামেরা, কম্পিউটার, ডিএনএ স্যাম্পলিং টুল নিয়ে দিনকে দিন ডারউইনের তত্ত্বকেই  এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ডারউইনের তত্ত্বের ভৌত বিজ্ঞানসমূহের সাথে গাঢ় এবং কার্যকর সম্পৃক্ততা কারণেই এই বছর তার জন্ম দ্বিশতবার্শিকী এবং তার মাস্টারপিস কর্ম অরিজিন অফ দ্য স্পিসিসের দেড়শত বার্ষিকী পালন করা হচ্ছে বিশাল ঘটা করে

ডারউইনের তত্ত্ব আধুনিক বিজ্ঞানের একটি মৌল ভিত্তি এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্স, আপেক্ষিকতা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তির সাথে সগর্বেই দাঁড়িয়ে আছে। কোপার্নিকাস যেমন পৃথিবীকে বিশ্বজগতের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি ডারউইনের বিশ্বজগতও প্রাকৃতিক জগতের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিয়েছে মানুষকে। মানুষ আর সৃষ্টির সেরা জীব নয় এখন, নয় কোন সৃষ্টিকর্তার বাছাই করা পেয়ারের বান্দা। বরং লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অন্য আরো হাজারো প্রজাতির মত জন্ম নিয়েছে মানুষ নামের প্রজাতিটি।

প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের ধারণা বোঝা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। প্রয়োজন শুধু কিছু বিতর্কিত প্রস্তাবনাগুলোকে সংযুক্ত করা। একই প্রজাতির মধ্যেও প্রাণীসত্তা পরস্পর থেকে ভিন্ন। এবং সময়ে সময়ে নতুন ধরনের প্রাণীসত্তা উদ্ভব হয়। কিছু ভিন্নতা পিতামাতা থেকে সন্তানের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। টিকে থাকার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে প্রাণীসত্তার বিকাশ হয় কোন নির্দিষ্ট স্থানে। এর ফলে ডারউইনের ভাষায় তৈরি হয় টিকে থাকা ভয়ংকর সংগ্রাম। এই সংগ্রামে দুর্বলটি বিনাশ হয়ে যায়। সক্ষমটি টিকে থাকে। টিকে থাকাগুলো তাদের বৈশিষ্ট্যগুলোকে ছড়িয়ে দেয় তাদের সন্তানসন্ততিদের মধ্যে। দীর্ঘ সময় পরে, এই বৈশিষ্ট্যগুলোই একসময় নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটায়।

এই সহজ সরল ধারণাকে ডারউইন প্রথম খেয়াল করেননি বা ধারণাগুলোকে একত্রিত করেননি। খ্রীষ্টপূর্ব ৪৯০ সালে গ্রীক দার্শনিক এমপেডোকলস (Empedocles) বলেছিলেন যে, কেন প্রাণীরা তাদের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ায় তা প্রাকৃতিক নির্বাচন হয়তো ব্যাখ্যা করতে পারে। টিকে থাকার সংগ্রাম তত্ত্ব পাওয়া যায় ৭৭৬ সালে বসরায় জন্ম নেওয়া মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক এবং দার্শনিক আল-জাহিজের লেখা থেকে। এই ধারণা আবার ভেসে উঠে সপ্তদশ শতাব্দীতে দার্শনিক টমাস হবস এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে ডারউইনের দাদা চার্লস ডারউইনের মাধ্যমে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বিবর্তনের ধারণা ডালপালা মেলতে শুরু করে। মোটামুটি সবাই এই ধারণায় বিশ্বাস করা শুরু করে যে প্রজাতি পরিবর্তনশীল। উদ্যানতত্ত্ববিদেরা তাদের সংকর প্রজাতির মাধ্যমে তা এর মধ্যেই দেখিছিলেন। কিন্তু যে জিনিষটা কেউ জানতো না তা হচ্ছে কিভাবে এই পরিবর্তনটা ঘটে। আর এখানেই ডারউইনের সমস্ত কৃতিত্ব।

ডারউইন তার তত্তওগুলোকে রূপ দেওয়া শুরু করেন ঊনবিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের শেষের দিকে। কিন্তু সেগুলোকে প্রকাশ করতে তিনি বিশ বছর অপেক্ষা করেন। তাও হয়তো করতেন না, যদি না রাসেল ওয়ালেস নামে তার একজন প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকতো। ওয়ালেসকে টেক্কা দেবার জন্যেই ওই সময় তড়িঘড়ি করে তিনি তার তত্ত্ব প্রকাশ করেন।

ডারউইনের তত্ত্বের সূচনা ছিল একেবারে কচ্ছপ গতিতে। লাইয়েল পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ধারণাকে জীবজগতে প্রয়োগ করেছিলেন তিনি। এক প্রজাতি থেকেই আরেক প্রজাতির উদ্ভব। জীববিজ্ঞানের রূপান্তরকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন সেই সময়কার অনেক বিবর্তনবাদী চিন্তাবিদরাই। কিন্তু তখন এই রূপান্তরকে ধারণা করা হতো উর্ধমুখী রূপান্তর হিসাবে। উর্ধ্বমুখী রূপান্তর হচ্ছে এরকম যে, প্রত্যেকটা প্রজাতির উদ্ভিদ বা প্রাণীই উপত্তি হয়েছে প্রাণহীন জড় পদার্থ থেকে এবং উদ্ভবের পর থেকেই সেগুলো অপ্রতিরোধ্যভাবে অধিক জটিল এবং নিখুঁত প্রজাতি হওয়ার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

ডারউইন এই সরলরৈখিক বিকাশকে প্রত্যাখান করেন এবং বলেন যে, প্রজাতির বিকাশ সরলরৈখিক নয় বরং শাখাবহুল। যেখানে কিছু প্রজাতি একই পূর্বপুরুষ থেকে জন্ম নিয়ে ভিন্ন পথে যাত্রা করে। এই ধারণা বিদ্যমান ধারণার পুরোপুরি বিপরীত ধরনের। প্রচলিত ধারণায় মনে করা হতো যে, নতুন একটি প্রজাতি তার পূর্বপুরুষ থেকে কতখানি আলাদা হতে পারে তার একটি নির্দিষ্ট সীমা আছে।


একই পূর্বপুরুষ থেকে শাখাময় বংশধারার বিবর্তন তুলনামূলকভাবে খুব কম সময়ে গৃহীত হয়ে যায়, কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেটি অত সহজ ছিল না। সাধারণ লোকতো দূরের কথা, এমনকি বৈজ্ঞানিক সমাজেও তা গৃহীত হয়নি শুরুতেই। না হওয়ার কারণটাও বোধগম্য। ডারউইন নিজেই উত্তরাধিকারের মেকানিজমকে ব্যাখ্যা করতে পারেন নাই। এক ধরনের কাল্পনিক ‘gemmules’  এর কথা বলেছেন যা টিস্যু থেকে উপত্তি হয়ে সেক্স অর্গানে যায় এবং সেখানে অনুরূপ তৈরি হবার পরে সেগুলো পরবর্তী প্রজন্মসমূহে স্থানান্তরিত হয়। বিংশ শতাব্দীর তিরিশ এবং চল্লিশের দশকে এসে প্রাকৃতিক নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া শুরু করে। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনকে জেনেটিকসের পথিকৃত গ্রেগর মেণ্ডেলের তত্ত্বের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। অরিজিন অব স্পিসিসের জন্মের একশ’ বছরের মধ্যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব তার অবস্থান নিশ্চিত করে ফেলে।

আধুনিক চিন্তাধারায় ডারউইনের প্রভাব

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বজগত সম্পর্কে আমাদের ধারণা উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কে দায়ী সে বিষয়ে কোন ঐক্যমতে আসা যায় না। কেউ কেউ বলেন কার্ল মার্ক্সের কথা, কেউ বা বলেন সিগমণ্ড ফ্রয়েডের কথা। আবার কেউ বা বলেন আইনস্টাইনের কথা।

কিন্তু জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গেলে এই সংশয় আর থাকে না বিন্দুমাত্র। গত দেড়শ’ বছরে অনেক জীববৈজ্ঞানিক ধারণা প্রস্তাবিত হয়েছে যেগুলো মানুষ যেভাবে সত্যকে দেখতো তার সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই ধারণাগুলোকে মেনে নেওয়ার জন্য একটা আদর্শিক বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল। চার্লস ডারউইনের মত এমন গড়পড়তা মানুষের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি এমন সুতীব্রভাবে পরিবর্তন আর কেউ করতে পারেনি।

ডারউইনের অবদান এমন বিপুল এবং ব্যাপক যে, তিনটি প্রধান ভাগে তার অবদানকে ভাগ করা যেতে পারে। সেগুলো হচ্ছে; বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান, বিজ্ঞানের দর্শন এবং আধুনিক চিন্তাধারা।

ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি

ডারউইন প্রাণ বিজ্ঞানের নতুন একটি শাখার জন্ম দেন। তা হচ্ছে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান। বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানে তার চারটি অবদান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি হচ্ছে প্রজাতির পরিবর্তনীয়তা, বা যাকে বলা যেতে পারে বিবর্তনের আধুনিক ধারণা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে শাখাময় বিবর্তনের ধারণা। এর অর্থ হচ্ছে এই পৃথিবীর সকল প্রাণীরই আদি উৎস এক। ১৮৫৯ সালের আগ পর্যন্ত জ্যা ব্যাপ্টিস্ট ল্যামার্কসহ সকল বিবর্তনীয় প্রস্তাবই সরলরৈখিক বিবর্তনকে সমর্থন দিয়েছে। ডারউইন আরো যোগ করেছিলেন যে বিবর্তন অবশ্যই ক্রমিক (gradual)। এতে বড় ধরনের কোন বিঘ্ন বা অধারাবাহিকতা নেই। সবশেষে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, বিবর্তনের উপায় (mechanism) হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন।

এই চারটি অন্তর্জ্ঞানই ডারউইনকে বিজ্ঞানের দর্শনের নতুন শাখা জীববিজ্ঞানের দর্শন তৈরিতে মূল ভূমিকা পালন করেছে। যদিও পূর্ণ বিকশিত হতে এই দর্শনের একশ’ বছর লেগে গেছে। তবে মূল ধারণা গড়ে উঠেছে ডারউইনের কনসেপ্ট থেকেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ডারউইন বিজ্ঞানে ঐতিহাসিকতার প্রবর্তন করেছিলেন। পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নের বিপরীতে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান ঐতিহাসিক বিজ্ঞান। বিবর্তনবাদীরা ইতোমধ্যেই ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। এই ঘটনা এবং প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করার জন্য সূত্র বা পরীক্ষণ যথাযথ কৌশল নয়। তার বদলে কোন একটি নির্দিষ্ট সিনারিওর পরীক্ষামূলক পুনর্নির্মাণ সহযোগে ঐতিহাসিক বর্ণনা তৈরি করা হয় সেই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য।

উদাহরণস্বরূপ, পৃথিবী থেকে হঠা করে ডাইনোসরের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পিছনে তিনটি ব্যাখ্যা প্রস্তাব করা হয়েছিল। মহামারী, জলবায়ুর হঠাৎ করে ব্যাপক পরিবর্তন এবং উল্কাপিণ্ডের প্রভাব, যাকে আলভারেজ তত্ত্ব (Alvarez theory) বলা হয়। প্রথম দুটো বর্ণনাই শেষ পর্যন্ত বাতিল করে দেওয়া হয় এর স্বপক্ষে কোন প্রমাণাদি না থাকায়। সব জানা তথ্য সমূহই আলভারেজ তত্ত্বকে সায় দেয়। ঐতিহাসিক বর্ণনার পরীক্ষণ যা বলতে চায় তা হচ্ছে, বিজ্ঞান এবং মানবিকের মধ্যে যে সুদূরপ্রসারী ব্যবধান ছিল তা আসলে অবিদ্যমান। এর মেথডোলজি এবং পরিবর্তন ঘটানো সম্ভবকারী সময় ফ্যাক্টরকে গ্রহণ করার ফলে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান এদের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসাবে কাজ করে।

ডারউইন এবং ওয়ালেসের প্রাকৃতিক নির্বাচন আবিষ্কার ছিল বড় ধরনের দার্শনিক অগ্রযাত্রা। দর্শনের ইতিহাসে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মূলনীতিগুলো এর আগে দুই হাজার বছর ধরে অজানা ছিল। প্রাকৃতিক নির্বাচনের অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে অভিযোজিত পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে। এর ধরন খুবই সহজ সরল। অনুন্নত প্রজাতিসমূহকে লুপ্ত করে দেয়াই এর পদ্ধতি। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে অনুন্নত প্রজাতিকে লুপ্ত করে দেয়ার ধারণাকে ডারউইনের সমসাময়িক দার্শনিক হার্বার্ট স্পেনসার ‘যোগ্যতম টিকে থাকবে’ এই বিখ্যাত বাক্যের মাধ্যমে বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তবে এই উক্তি দীর্ঘদিন চক্রাকার যুক্তি হিসাবে হাসি ঠাট্টার শিকার হয়েছে। ‘যোগ্যতম কে? যারা টিকে থাকে’। বাস্তবে, খুব সতর্কভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে কেন কিছু বিশেষ পরিবেশে কিছু কিছু প্রজাতি টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়।

প্রাকৃতিক নির্বাচনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে এটি ঐশ্বরিক চুড়ান্ত কারণকে অপ্রয়োজনীয় করে ফেলেছে। কোন কিছুই আর পূর্ব নির্ধারিত নয় এখন। এমনকি, নির্বাচনের উদ্দেশ্যও পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে সাথে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পালটে যেতে পারে।

প্রাকৃতিক নির্বাচন ঠিকঠাকভাবে কাজ করার জন্য বৈচিত্র্যময় প্রজাতিসমূহের সমাহার প্রয়োজন। বৈচিত্র্যের গুরুত্ত্বের কারণে প্রাকৃতিক নির্বাচনকে দ্বিস্তর বিশিষ্ট প্রক্রিয়া হিসাবে বিবেচনা করা হয় ব্যাপক বৈচিত্র্যের সমাহারের পরেই আসে অনুন্নত প্রজাতির বিলুপ্তি। পরের ধাপটি সুনির্দিষ্ট। প্রাকৃতিক নির্বাচনকে গ্রহণ করার মাধ্যমে ডারউইন দৈবতা না প্রয়োজনের কারণে পরিবর্তন হয় সে বিষয়ে দার্শনিকদের মধ্যে কয়েক হাজার বছর ধরে চলে আসা বিতর্ককে সমাধান করতে সক্ষম হন। প্রজাতির পরিবর্তন দু’টো কারণেই হয়ে থাকে। প্রথম পর্যায় হচ্ছে এলোপাতাড়িভাবে (Randomly) এবং দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে প্রয়োজনের তাগিদে।

ডারউইনীয় চিন্তা-ভাবনা

একবিশ শতাব্দীর একজন মানুষ ভিক্টোরিয়ান যুগের কোন মানুষের চেয়ে ভিন্নভাবে পৃথিবীকে দেখে থাকে। এই দৃষ্টিঙ্গিগত পরিবর্তনের পিছনে অনেক কারণ রয়েছে বিশেষ করে টেকনোলজির অবিশ্বাস্য ব্যাপক পরিবর্তনের ভুমিকা অনেকখানিই । কিন্তু চিন্তাধারার এই ব্যাপক পরিবর্তনের পিছনে যে ডারউইনের ধারণাসমূহের বিশাল ভূমিকা রয়েছে তাকে স্বীকার করা হয়নি তেমন করে

১৮৫০ সালে সকল প্রথিতযশা বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকেরা ছিলেন খ্রীষ্টান লোক। যে পৃথিবীতে তারা বসবাস করতেন তা সৃষ্ট হয়েছে ঈশ্বর কর্তৃক। প্রাকৃতিক ধর্মতাত্তত্বিকেরা মনে করতেন যে,  ঈশ্বর তার বিচক্ষণ সূত্রসমূহের মাধ্যমে সকল প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণীর একে অপরের সাথে এবং পরিবেশের সাথে নিখুঁত অভিযোজনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ডারউইনের প্রস্তাবিত মৌলিক সূত্রসমুহীরকম বিদ্যমান ধারণার সাথে একেবারে বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করে।

প্রথমতঃ ডারউইনবাদ সকল অলৌকিক প্রপঞ্চ এবং কার্যকারণকে বাতিল করে দেয়। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের তত্ত্ব প্রাণীজগতের অভিযোজন এবং বৈচিত্র্যতাকে একেবারে বস্তবাদী উপায়ে ব্যাখ্যা করেছে।  এতে আর ঈশ্বর নামক কোন সৃষ্টিকর্তা বা ডিজাইনারের কোন প্রয়োজন নেই। ডারউইন নির্দেশ করেন যে, বাইবেল বা অন্যান্য ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থে সৃষ্টির যে বর্ণনা দেওয়া আছে তা প্রাকৃতিক জগতের সাথে সম্পূর্ণ বিরোধপূর্ণ। প্রাকৃতিক ধর্মতাত্ত্বিকদের মুগ্ধাবিষ্ট ‘বিস্ময়কর ডিজাইনের’ সকল দিককেই প্রাকৃতিক নির্বাচন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। বিজ্ঞান থেকে ঈশ্বরকে আলাদা করে ফেলার ফলে সকল প্রাকৃতিক প্রপঞ্চের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। এর ফলে বৈজ্ঞানিক জগতে অত্যন্ত শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আত্মিক বিপ্লবের সৃষ্টি হয় যার প্রভাব এখন পর্যন্ত রয়ে গেছে।

দ্বিতীয়তঃ ডারউইন টাইপোলজিকে খণ্ডন করেছেন। পীথাগোরাস এবং প্লেটোর সময় থেকেই প্রাণী জগতের বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে ঐক্য এবং সুস্থিতিতার উপর জোর দেওয়া হতো। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বলা হয়, টাইপোলজি বা অপরিহার্যবাদ (Essentialism)। যে বৈচিত্র্য আছে প্রাণী জগতে এবং উদ্ভিদ জগতে তা খুবই সামান্য কিছু প্রাকৃতিক ধরনের এবং এই ধরনগুলোই এক একটি শ্রেণী গঠন করে। একই শ্রেণীর সদস্যদেরকে হুবহু অনুরূপ এবং ধ্রুব এবং তারা অন্য শ্রেণীর সদস্যদের থেকে প্রচণ্ডভাবে আলাদা বলে মনে করা হতো।

ডারউইন এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বাতিল করে দেন এবং সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ধারণা প্রবর্তন করেন। মানুষসহ সকল জীবিত প্রাণী বা উদ্ভিদের সকল গ্রুপের সদস্যা যার যার মতো আলাদা। ছয় বিলিয়ন লোকের মধ্যে এমন কোন দুইজন লোককেই পাওয়া যাবে না যারা হুবহু অনুরূপ।

তৃতীয়তঃ ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব সকল ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপকেই অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে। গ্রীকদের সময় থেকেই সার্বজনীন একটা বিশ্বাস ছিল যে, ঐশ্বরিক শক্তি সবকিছুকেই অধিকতর  নিখুঁততার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এরিস্টটল এরকম একটি কারণ হিসাবে ‘চুড়ান্ত কারণের’ কথা উল্লেখ করেছেন। কান্টও (Kant) নিউটোনিয়ান পদার্থবিদ্যার সূত্র দিয়ে জীববৈজ্ঞানিক প্রপঞ্চকে ব্যাখ্যা করার অসফল চেষ্টা করেছিলেন। ১৮৫৯ সালের পরেও বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানে ঐশ্বরিক ব্যাখ্যা জনপ্রিয় ছিল। ডারউইনবাদ এসে এই সমস্ত ধ্যান ধারণাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেয়।

চতুর্থতঃ ডারউইন ডিটারমিনিজমকেও বিদায় করে দেন। লাপ্লাস ( Laplace) মনে করতেন যে, বর্তমান বিশ্বজগত এবং এর প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকলে অসীম ভবিষ্যত সম্পর্কেও ভবিষ্যতবাণী করা সম্ভব। এর বিপরীতে ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া জুড়ে এলোপাতাড়িময়তা এবং দৈবতাকে গ্রহণ করেছেন। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় দৈবের কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে সেটা অনেক পদার্থবিদের কাছেই অগ্রহণযোগ্য ছিল। আইনস্টাইন ‘ঈশ্বর পাশা খেলে না’ এই বক্তব্যের মাধ্যমে দৈবের প্রতি তার অনীহাকে প্রকাশ করে গেছেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রথম ধাপ, বৈচিত্র্যতার সৃষ্টি পুরোপুরি দৈবের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপ, প্রকৃত নির্বাচন সম্পূর্ণ সুনির্দিষ্ট।

পদার্থবিদ এবং দার্শনিকদের প্রাথমিক বাধা সত্ত্বেও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় আকস্মিক ঘটনার এবং দৈবের ভূমিকা সার্বজনীনভাবে গৃহীত। অনেক জীববিজ্ঞানী এবং দার্শনিকেরা জীববিজ্ঞানে সার্বজনীন সূত্রের অবস্থানকে অস্বীকার করেন।

পঞ্চমতঃ ডারউইন বলেন যে সৃষ্টিজগতে মানুষ কোন বিশেষ সৃষ্টি না। আর এর মাধ্যমে তিনি নতুন ধরনের মানবকেন্দ্রিকতা তৈরি করেন। তার সমসাময়িক লোকদের ডারউইনের মতবাদের যে অংশটা মানতে কষ্ট হয়েছিল তা হচ্ছে অন্যান্য প্রাণীর মত মানুষের ক্ষেত্রেও একই পূর্বপুরুষের ধারণা ব্যাখ্যা করা। ধর্মতাত্ত্বিক এবং দার্শনিকদের মতে, মানুষ ছিল সৃষ্টিজগতের অন্য প্রাণীর থেকে আলাদা এবং শ্রেষ্ঠতর। এরিস্টটল, ডেকার্টে এবং কান্ট অনেক কিছুতেই একমত না হলেও এই বিষয়ে পুরোপুরি একমত ছিলেন। কিন্তু জীববিজ্ঞানী টমাস হাক্সলি (Thomas Huxley) এবং আর্নস্ট হ্যাকেল (Ernst Haeckel) ব্যাপক তুলনামূলক পরীক্ষণের মাধ্যমে দেখান যে, মানুষ এবং এপের পূর্বপুরুষ একই। তাদের এই ধারণা পরবর্তীতে আর কখনোই বিজ্ঞানে প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। একই পূর্বপুরুষের তত্ত্ব মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগের ফলে প্রাণীজগতে মানুষের আগের যে বিশেষ মর্যাদা ছিল তা নড়ে গেছে সন্দেহাতীতিভাবেই।

যদিও এর মানে এই নয় যে, এর ফলে মানবকেন্দ্রিকতা একেবারে শেষ হয়ে গেছে। মানুষের উপর গবেষণায় দেখা গেছে যে, এর উৎপত্তি একই পূর্বপুরুষ থেকে হওয়া সত্ত্বেও সকল প্রাণীর মধ্যে এর বৈশিষ্ট্য অনন্য। যে কোন প্রাণীর চেয়ে মানুষের বুদ্ধিমত্তা অনেক অনেক বেশি। মানুষই একমাত্র প্রাণী যার ব্যাকরণ এবং বাক্যরীতি সহযোগে ভাষা আছে। ডারউইনের মতে একমাত্র মানুষই প্রকৃত নৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। উচ্চ বুদ্ধিমত্তা, ভাষা এবং দীর্ঘকাল সন্তানের যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা সমৃদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। ভাল হোক বা মন্দ হোক এর মাধ্যমেই মানুষ গোটা পৃথিবীতে একচ্ছত্র আধিপত্য গড়ে বিস্তার করেছে।

ষষ্ঠতঃ ডারউইন নৈতিকতার একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রদান করেছেন। সবসময়ই প্রশ্ন তোলা হয় যে, বিবর্তন কি মানুষের নৈতিকতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে কিনা। অনেকেরই ধারণা যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন যদি কোন ব্যক্তির শুধুমাত্র নিজের অস্তিত্ব রক্ষা এবং প্রজননের সাফল্যকে বৃদ্ধি করার আত্মকেন্দ্রিক আচরণকে পুরস্কৃত করে থাকে তবে সেই ধরনের আত্মকেন্দ্রিক আচরণ কোন নৈতিকতা সৃষ্টি করতে পারে কিনা? হার্বার্ট স্পেনসার কর্তৃক বিকশিত সোস্যাল ডারউইনিজম অনুযায়ী নৈতিকতার বিকাশের ক্ষেত্রে বিবর্তনীয় ব্যাখ্যা অচল।

আজকে আমরা জানি যে, সামাজিক প্রজাতির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ব্যক্তি নয় বরং গোটা সামাজিক দলই নির্বাচনের লক্ষ্য হতে পারে। ডারউইন ১৮৭১ সালে এই যুক্তিটাই মানব প্রজাতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন। একটি সামাজিক দলের অস্তিত্ব রক্ষা এবং সমৃদ্ধি সেই দলের সদস্যদের মধ্যে সুসমন্বিত সহযোগিতার উপর অনেকখানি নির্ভর করে। এই সহযোগিতা পরার্থবাদেরও (Altruism) উপর নির্ভর করে। এই পরার্থবাদ দলের টিকে থাকা এবং সমৃদ্ধিতে সহযোগিতা করার সাথে সাথে দলের সদস্যদের যোগ্যতা বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।

দল নির্বাচন এবং পারস্পরিক সহযোগিতা সামাজিক দলকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে। অন্যান্য সামাজিক প্রাণীসমূহের মধ্যে ঐ ধরনের পরার্থবাদ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গেছে। সামাজিক দলের মধ্যে পরার্থবাদের আধিক্য এবং সুসমন্বিত সহযোগিতাকে নির্বাচন পক্ষপাত দেখায়। এর মধ্য দিয়েই যে কেউ বিবর্তন এবং নৈতিকতার সম্পর্ক দেখাতে পারে। সোস্যাল ডারউইনের পুরনো ধারণা প্রাণী, বিশেষ করে সামাজিক প্রাণীসমূহের উপর অসম্পূর্ণ ধারণা থেকে গড়ে উঠেছিল।

বিবর্তনের সমর্থন

ডারউইনের তত্ত্ব যতই বৈপ্লবিক হোক না কেন একে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে যেমন সমস্যা ছিল এখনো সেই রকমই সমস্যা রয়ে গেছে। ২০০৬ সালে পরিচালিত গ্যালুপ পরিচালিত এক জরীপে দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১৪ শতাংশ লোক একমত যে, মানুষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের মাধ্যমে জন্মেছে। এই হার ১৯৮২ সালে ছিল মাত্র ৯ শতাংশ। বিবর্তনকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে দেশে দেশেও বিভেদ রয়েছে। বিবর্তনের প্রতি সবচেয়ে পক্ষপাত রয়েছে আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক এবং সুইডেনের। কোন দেশের লোকজনের ঈশ্বর বিশ্বাসের সাথে বিবর্তনে বিশ্বাস বিপরীতমুখী সহসম্পর্কযুক্ত।


চিত্র ১: বিবর্তনের সমর্থন দেশে দেশে 
তবে এখানে মজার একটা বিষয় রয়েছে। বিবর্তনের উপর গবেষক গ্রেগরী পল এবং পিটজার কলেজের সমাজবিজ্ঞানী ফিল জুকারম্যান যুক্তি দিয়েছেন যে, ঈশ্বরে বিশ্বাস করা দেশের লোকের টিকে থাকার সংগ্রামের মাত্রার সাথে বিপরীতমুখী সহ-সম্পর্কযুক্ত। যে সমস্ত দেশে খাদ্যের প্রাচুর্য রয়েছে, স্বাস্থ্য সেবা সার্বজনীন এবং বসতবাটি সহজলভ্য সেখানে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস যে সমস্ত দেশে ওই বিষয়গুলো অনিশ্চিত তার চেয়ে কম।